প্রকল্পের নাম ‘পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও সুন্দর পুরুলিয়া’। আড়াই বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ফাইল তুলে দিয়ে ওই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রীর পুরুলিয়ায় আসার আগে শহর ঘুরে দেখা গেল বাস্তব ছবিটা অন্য। সঙ্গের ছবিটি শশধর গাঙ্গুলী রোডের। ছবি: সুজিত মাহাতো
দুর্গন্ধ ছড়ালে তবেই দেখা মিলবে সাফাইকর্মীর এমনই মস্করা চালু রয়েছে পুরুলিয়া শহরে। বছর-বছর পুরসভার অন্দরে সাফাই নিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা তৈরি হয়, কিন্তু শহরের পথঘাট আবর্জনা জমে থাকার ছবিটা বদলায় না।
পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার পথের ঠিক উল্টোদিকে মেন রোড ও রেডক্রশ রোডের সংযোগস্থল। বেলা ১০টা। রাস্তার এক পাশে ডাঁই করা আছে আবর্জনার স্তূপ। গাড়ির চাকায়-চাকায় সেই আবর্জনা ছড়াচ্ছে রাস্তায়। পথচারীরা তো বটেই, এই রাস্তা ধরেই রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়, মানভূম ভিক্টোরিয়া ইন্সস্টিটিউশন-সহ দু’টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়ারা যাতায়াত করছে। আবর্জনার দুর্গন্ধে তারা নাকে রুমাল চাপা দিচ্ছে।
এটাই এই এলাকার রোজকার ছবি। এখানেই শেষ নয়। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, অঝোরে বৃষ্টি নামলে জলে ভেসে ওই আবর্জনা গিয়ে পড়ে শহরের ফুসফুস বলে পরিচিত সাহেব বাঁধেও। সাহেববাঁধ সংস্কারে তাই আশপাশের নোংরা জল আটকাতে চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির আগাছা লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে সওয়া তিন কোটি টাকা।
এমন দৃশ্য শতবর্ষ প্রাচীন এই শহরের বিক্ষিপ্ত কোনও ছবি নয়। চাইবাসা রোডে কাপড় গলির মুখে যে এলাকা শহরের অন্যতম প্রধান বাজার বলে পরিচিত, সেখানেও একই ভাবে রাস্তার উপরেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডাঁই করা থাকে আবর্জনা। মেন রোডের উপরে চকবাজার কালীমন্দির সংলগ্ন এলাকায় রাস্তার উপরে আবর্জনার পাহাড়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে শুধু এ রকম দু-চারটি রাস্তা নয়, অন্যান্য এলাকা ঘুরলে এমনই ছবি চোখে পড়বে। এই শহরের আবর্জনা সাফাই নিয়ে বাসিন্দাদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রবীণরা জানাচ্ছেন, যখন শহর আকারে আয়তনে এতটা বাড়েনি তখনও শহর পরিচ্ছন রাখার বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। এখন তো সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। পুরবাসীর কথায়, নানা প্রতিশ্রুতির কথা প্রতিবারই ভোটের আগে শোনা যায়। পুরসভায় ক্ষমতার বদল হয়। কিন্তু সমস্যা মেটে না।
পুরসভা সূত্রের খবর, গতবার বামফ্রন্ট পরিচালিত পুরবোর্ড জঞ্জাল-সমস্যা থেকে শহর মুক্ত করতে বিভিন্ন পাড়া থেকে আবর্জনা না তুলে বাড়ি বাড়ি জঞ্জাল সাফাই করার পরিকল্পনা করেছিল। ২২টি ওয়ার্ডেই প্রায় প্রতিটি বাড়িতে আবর্জনা জমানোর জন্য প্লাস্টিকের বালতি দিয়েছিল পুরসভা। প্রতিদিন সকালে পুরসভার সাফাই কর্মীরা ওই বালতির ময়লা তুলে আনতেন। কিছুদিন তা চললেও এখন দু-একটি ওয়ার্ড বাদে বাকি এলাকায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
২০১১ সালে জেলা প্রশাসন ও পুরসভা যৌথ ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় শহরকে সাফ-সুতরো ও সবুজ করে তোলা হবে। সে বার নভেম্বর মাসে মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রথম জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করতে আসেন। তখন তাঁর হাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম সংক্রান্ত রিপোট তুলে দেওয়া হয়। সেই রিপোর্টে ‘মিউনিসিপ্যাল অ্যাফেয়ার্স’ শিরোনামে একটি কলমে জানানো হয়েছিল ‘ক্লিন, গ্রিন এন্ড বিউটিফুল পুরুলিয়া’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পেরই আওতায় ছিল দোকানে-দোকানে ডাষ্টবিন রাখতে হবে। আবর্জনা রাস্তায় ফেলা যাবে না। এ নিয়ে প্রচারও শুরু হয়। জেলা প্রশাসনের শীর্ষকর্তা থেকে পুরপ্রধান মানুষকে সচেতন করতে পথে নামেন। সেই প্রকল্প কিন্তু এখনও ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।
কী বলছেন শহরবাসী?
শশধর গঙ্গোপাধ্যায় রোডের বাসিন্দা একটি হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক উষ্ণীষমণি মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “সাফাই নিয়মিত হয় না। নর্দমা থেকে নোংরা রাস্তার পাশে তুলে ক’দিন পরে নিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে শুয়োর এসে ঘেঁটে ফের নর্দমায় ফেলে দেয়।” নামোপাড়ার বধূ শম্পা সরকার বলেন, “সপ্তাহে একদিন কি দু’দিন আবর্জনা সাফাই হয়। এই বর্ষায় জল ও আবর্জনা মিশে নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।”
আবার পুরুলিয়া চেম্বার অফ ট্রেড এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রি-র সম্পাদক গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতে, “ইদানীং শহরের সাফাই নিয়ে সমস্যা দেখছি। তার কারণ পুরসভার এত অস্থায়ী কর্মী, যে তাঁদের বেতনের অর্থ জোগাড় করা সমস্যার হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব পড়ছে শহরের কাজকর্মে।” স্কুলছাত্রী স্নিগ্ধা সরকার জানিয়েছেন, ‘এই শহরটা আমার’এই উপলব্ধি থাকলে পুরকর্তারা শুধু সাফাইয়ের কাজই নয়, আরও অনেক কাজও ভাল ভাবে করতে পারবেন।
বিরোধীদের অভিযোগ, সাফাই বিভাগ প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। আগে শহরের সাফাই নিয়ে এথ অভিযোগ উঠত না। কিন্তু বর্তমান বোর্ড সেই একই পরিকাঠামো নিয়ে সাফাইয়ের কাজ ঠিকমতো করতে পারছে না। বিরোধী কাউন্সিলররা সাফাই নিয়ে আগে নেওয়া পরিকল্পনাগুলি কার্যকর করার দাবি তুলেছেন। তবে পুরপ্রধান তৃণমূলের তারকেশ চট্টোপাধ্যায় দাবি, “সাফাইয়ের কাজ যে হচ্ছে না তা নয়। তা হলে পরিস্কার করছে কে? তবে কিছু সমস্যা আছে। সে সব মোকাবিলা করেই সাফাইয়ের কাজ করা হচ্ছে।”
বিরোধী ও শাসকদলের এই চাপানউতোরের মধ্যেই এক বছর পরে পুরভোটের বাদ্যি বাজবে পুরুলিয়ায়। তখন অবশ্য জনগণই শেষ কথা বলবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy