Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

স্কুল পালানোর অ্যাডভেঞ্চার শেষ হল হাওড়া স্টেশনেই

ট্রেনে পাঁচ ঘণ্টার পথ বেশ মজায় কেটেছিল। কিন্তু রাতে হাওড়া স্টেশনে নেমে চারপাশে অচেনা লোকের গিজগিজে ভিড় দেখেই উধাও হয়ে গিয়েছিল অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ। পরীক্ষায় খারাপ ফলের জন্য যে বাড়ির লোকেদের বকাঝকায় কষ্ট পেয়ে পালিয়ে এসেছিল বাঁকুড়ার তিন স্কুল ছাত্রী, সেই বাড়ির লোকজনেরই জন্য তখন মন কেঁদে উঠেছিল তাদের। স্টেশনের বাইরে পা ফেলতেই মোটরবাইকে দুই যুবকের চোখের চাউনি দেখে আর নিজেদের জেদ ধরে রাখতে পারেনি ওরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৪ ০০:১৩
Share: Save:

ট্রেনে পাঁচ ঘণ্টার পথ বেশ মজায় কেটেছিল। কিন্তু রাতে হাওড়া স্টেশনে নেমে চারপাশে অচেনা লোকের গিজগিজে ভিড় দেখেই উধাও হয়ে গিয়েছিল অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ। পরীক্ষায় খারাপ ফলের জন্য যে বাড়ির লোকেদের বকাঝকায় কষ্ট পেয়ে পালিয়ে এসেছিল বাঁকুড়ার তিন স্কুল ছাত্রী, সেই বাড়ির লোকজনেরই জন্য তখন মন কেঁদে উঠেছিল তাদের। স্টেশনের বাইরে পা ফেলতেই মোটরবাইকে দুই যুবকের চোখের চাউনি দেখে আর নিজেদের জেদ ধরে রাখতে পারেনি ওরা। এক যাত্রীর মোবাইল ফোন থেকে সোজা বাবাকে ফোন করে এক ছাত্রী। তার পরে মঙ্গলবার রাতটা হাওড়া জিআরপি-র কাছে থেকে বুধবার ভোরে তাদের বাড়ি ফেরা।

মঙ্গলবার সকালে পিঠে স্কুল ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ওই তিন ছাত্রী। বাঁকুড়া শহর লাগোয়া একটি স্কুলে তারা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুল ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, স্কুল বাসেই তারা স্কুলে যায়। স্কুলে ঢুকেই তারা ক্লাসঘরে না গিয়ে সোজা বাথরুমে চলে যায়। স্কুল ইউনিফর্ম খুলে ব্যাগে ভরে রাখা সাধারণ জামাকাপড় তারা পরে নেয়। তারপরে গুটি গুটি পায়ে স্কুলের গেট টপকে তিনজনে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু গোল বেধেছিল শুরুতেই। পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না হওয়ায় ওই তিনজনের সঙ্গে আরও এক ছাত্রীকেও বাড়িতে ক’দিন ধরে বকাঝকা শুনতে হচ্ছিল। তাই তারা ফন্দি এঁটেছিল ব্যাগে পোশাক ও টাকা নিয়ে আসবে। স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু মঙ্গলবার স্কুলে গিয়ে তারা জানতে পারে, এক ছাত্রী যাবে না। প্রথমে কিছুটা দমে গেলেও বাকিরা ফন্দি বাতিল করেনি। স্কুলের গেটের বাইরে থেকে তারা বাঁকুড়া স্টেশনে চলে যায়। সেখান থেকে তারা ‘আরণ্যক এক্সপ্রেস’-এ চড়ে বসে।

বাড়ির লোক তখনও জানেন না কি ঘটেছে। স্কুলের শেষ পিরিয়ডের সময় তাদের নিখোঁজ হওয়ার খবর জানাজানি হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে আসে ওই তিন ছাত্রী স্কুলে আসেনি। কেন আসেনি? তাদের সহপাঠীদের কাছে খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, তারা স্কুলে এলেও ক্লাস করেনি। স্কুল থেকে বাড়িতে ফোন যায়। সেখানেও তারা ফিরে যায়নি। গেল কোথায় মেয়েগুলো? থানায় ছুটে যান স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রীদের পরিজনেরা। খোঁজ শুরু করে পুলিশ জানতে পারে, তিনটি কম বয়েসি মেয়ে সকালের দিকে বাঁকুড়া স্টেশন চত্বরে ঘোরাঘুরি করছিল। সম্ভবত তারা ট্রেনে চড়েছে। খবর ছোটে বাঁকুড়া থেকে আশপাশের স্টেশনের জিআরপি থানায়। শুরু হয়ে যায়, পুলিশ ও রেল পুলিশের খোঁজাখুঁজি।

ততক্ষণে ওই তিন কন্যা ট্রেন থেকে সাঁতরাগাছি স্টেশনে নেমে অন্য ট্রেন ধরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিল। সঙ্গে আনা টাকা খরচ করে কিছু খাবারও তারা খায়। কিন্তু স্টেশনে লোকজনের ভিড় দেখে তাদের ভিড়মি খাওয়ার অবস্থা। স্টেশন চত্বরেই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে তারা ঘোরাঘুরি করতে থাকে। একটু একটু করে ভয় লাগলেও তারা বাড়িতে খবর দিতে চাইছিল না। এ দিকে, বাড়ির লোকজনের তখন উৎকণ্ঠা চরমে উঠেছে। বাঁকুড়া জিআরপি স্টেশনে ওসি সুভাষচন্দ্র জানার সঙ্গে অপেক্ষায় ছাত্রীদের পরিজনেরা। একে একে খবর আসছিল, খড়্গপুর, সাঁতরাগাছি থেকে বিভিন্ন স্টেশনে রেলপুলিশের কর্মীরা খোঁজ শুরু করেছেন, কিন্তু ওদের হদিশ কোথাও নেই।

ওসি একের পর এক জায়গায় ফোন করছেন, ‘কিছু খবর পেলেন?’ উত্তর একটাই ‘না’। শুনে মাথা চুলকে ওসি-র দীর্ঘশ্বাস- ‘কোথায় যে গেল মেয়ে তিনটে!’ সময় যতই গড়িয়েছে নিখোঁজ ছাত্রীদের পরিবারের লোকেদের মধ্যে উৎকন্ঠাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ঘড়িতে তখন রাত পৌনে ১১টা। এমন সময় এক ছাত্রীর বাবার ফোন বেজে ওঠে। অচেনা নম্বার থেকে ফোন। চেনা গলা ‘বাবা, আমরা হাওড়া স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। একটা মোটরবাইকে দু’টো ছেলে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জানি না এরা কারা।’ ফোন হাতে নেন ওসি। তিনি বলেন, ‘তোমরা এখনই হাওড়া স্টেশনের জিআরপি থানায় খোঁজ করে যাও।’, ফোন গেল কেটে। ওসি সঙ্গে সঙ্গে খড়্গপুর এসআরপি-কে ফোন করে ঘটনাটি জানিয়ে হাওড়া জিআরপি-কে বিষয়টি জানিয়ে রাখতে অনুরোধ জানান। কিছুক্ষণ পরে তিনি হাওড়া জিআরপি থানায় ফোন করেন। সেখান থেকে খবর পান, মেয়ে তিনটি থানায় এসেছে। মহিলা রেলপুলিশ কর্মীদের কাছে তারা রয়েছে। শুনে শান্তি পেলেও স্বস্তি পাননি মেয়েগুলির পরিজনেরা। গাড়ি নিয়ে তাঁরা রাতেই হাওড়া ছোটেন। হাওড়ায় তাঁরা পৌঁছে যখন মেয়েদের দেখতে পান, তখন ভোর। মেয়েদের ফিরে পেয়ে তাঁদের ধড়ে যেন প্রাণ আসে।

মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক ছাত্রীর বাবা বলেই ফেললেন, “পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার জন্য একটু ধমক দিয়েছিলাম। তাতে অভিমান করে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে ভাবতেই পারিনি। মেয়েকে হারিয়ে এই কয়েক ঘণ্টা আমাদের যে কী দশা হয়েছে ভাষায় বোঝানো যাবে না।” তিনি জানান, হাওড়া জিআরপি থানার মহিলা পুলিশ কর্মীরা মেয়েদের বকাঝকা করতে নিষেধ করেছেন। ওই ছাত্রীরা জানিয়েছে, প্রথমে ট্রেনে চড়ার পরে খুব মজাতেই তারা ছিল। কিন্তু হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার পরে এত মানুষের ভিড় দেখে নিজেদের তারা অসহায় মনে করে। তখনই তাদের বাড়ি ফিরতে মন উতলা হয়ে ওঠে। পাছে না বলে পালানোর জন্য ফের বাড়ির লোকেরা আবার বকুনি গেয় সেই ভয়ে তারা পিছিয়ে যায়। কিন্তু রাত যত বাড়তে থাকে অচেনা জায়গায় আরও ঘাবড়ে যায় তিনজন। বিভিন্ন ধরনের অচেনা মুখ দেখে তারা ভয় পায়। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা টাকা পয়সাও প্রায় শেষের মুখে। শেষে বাবাকে ফোন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

truant adventure howrah bankura
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE