Advertisement
E-Paper

সরকারি পরিষেবা মেলে না, ভরসা হাতুড়েরাই

এলাকায় ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে বটে, কিন্তু তাতে ভরসা পান না অনেকেই। বেসরকারি ভাবে ভালো চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থাও তেমন নেই। ফলে বরাবাজারের গ্রামে-গঞ্জের এখনও বড় অংশের মানুষের ভরসা হাতুড়েরাই। যাঁরা অবস্থাপন্ন তাঁরা গাড়ি ভাড়া করে ৪৫ কিলোমিটার দূরের জামসেদপুর অথবা ৪০ কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যান। চারপাশে কত কি বদলে যাচ্ছে, কিন্তু গত এক দশকে বরাবাজারের এই স্বাস্থ্য-পরিষেবার অব্যবস্থার ছবিটা বদলায়নি।

সমীর দত্ত

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৬
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ছাউনি এখনও টিনের। তাতেই চলছে অপারেশন থিয়েটার। ছবি: প্রদীপ মাহাতো

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ছাউনি এখনও টিনের। তাতেই চলছে অপারেশন থিয়েটার। ছবি: প্রদীপ মাহাতো

এলাকায় ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে বটে, কিন্তু তাতে ভরসা পান না অনেকেই। বেসরকারি ভাবে ভালো চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থাও তেমন নেই। ফলে বরাবাজারের গ্রামে-গঞ্জের এখনও বড় অংশের মানুষের ভরসা হাতুড়েরাই। যাঁরা অবস্থাপন্ন তাঁরা গাড়ি ভাড়া করে ৪৫ কিলোমিটার দূরের জামসেদপুর অথবা ৪০ কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যান। চারপাশে কত কি বদলে যাচ্ছে, কিন্তু গত এক দশকে বরাবাজারের এই স্বাস্থ্য-পরিষেবার অব্যবস্থার ছবিটা বদলায়নি।

বরাবাজারের শুকুরহুটু গ্রামের বিপ্লব মাহাতো জানান, সম্প্রতি তাঁর বছর পাঁচেকের এক ভাইঝির পা ভেঙেছিল। বরাবাজার ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁদের জানান, সেখানে এক্স-রে করার সুযোগ নেই। চিকিৎসক তাঁদের বাইরে থেকে এক্স-রে করিয়ে আনতে বলেন। হয়রানির এখানেই শেষ নয়। তাঁর অভিযোগ, “চিকিৎসকের পছন্দমতো ক্লিনিক থেকে এক্স-রে করানো হয়নি বলে তিনি এক-রে প্লেটটা ছুড়ে ফেলে দেন। এর পরে আর ওখানের উপরে ভরসা না রেখে ভাইঝিকে পুরুলিয়ায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাই।”

ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বহির্বিভাগে রোগীরা সকাল ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে থেকেও ডাক্তারের দেখা পাননি, এমন অভিযোগও রয়েছে। এ নিয়ে বহুবার রোগীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কিন্তু, অবস্থা পাল্টায়নি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগে কোয়ার্টারে বসেই বিএমওএইচ প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। বাসিন্দাদের বিক্ষোভের ঠেলায় কোয়ার্টারে প্র্যাকটিস বন্ধ হলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্র লাগোয়া রাস্তার ধারে বসে এখন অফিস টাইমেও তিনি প্র্যাকটিস করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বরাবাজারের বিডিও অনিমেষকান্তি মান্নাও বলেন, “এক রবিবার আমি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখি বিএমওএইচ নেই। কর্মীরা জানান, তিনি বাইরে গিয়েছেন। অথচ আমার নিরাপত্তা রক্ষী খোঁজ নিয়ে জানায়, তিনি কাছেই একটি চেম্বারে প্র্যাকটিস করছেন। আমার ফোনও তিনি ধরেননি। অফিস টাইমে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে তিনি মোটেই ভালো কাজ করছেন না।” জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষের অবশ্য যুক্তি, “সব কিছু তো পুরুলিয়া সদর থেকে দেখতে পারি না। বরাবাজারের বিএমওএইচের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।”

এই সব অভিযোগের বিষয়ে বিএমওএইচ পরিতোষ সরেন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি ১৬ বছর বরাবাজারে আছেন। এই সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরাতে তিনি কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা জানতে চাইলে তিনি বলে দেন, “আমি সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলব না!”

বাসিন্দাদের প্রশ্ন, জেলা স্বাস্থ্যদফতর এমন গয়ংগচ্ছ মনোভাব দেখালে কি আদৌ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল পাল্টাতে পারে? ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত সাফাইয়ের বালাই নেই। নিকাশি নালায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বর্জ্য জমে নালার মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নোংরা জল নালা উপচে আশপাশে গড়াচ্ছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবাধে কুকুর, গরু, ছাগল চরে বেড়ায়। এক রোগীর আত্মীয় বলেন, “আমার কাকা এখানে ভর্তি আছেন। রোগীদের মাথার উপর পাকা ছাদ নেই। অ্যাসবেসটরের ছাউনির নীচে থাকায় রোগীদের শীতে খুব কষ্ট হচ্ছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পাওয়া কম্বলেও শীত মানেনি। বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে আরও কম্বল নিয়ে এসেছি।” বিডিও নিজেও বলছেন, “রোগীদের মাথার উপরে অ্যাসবেসটরের ছাউনি থাকায় শীতে ও গরমে রোগীরা কষ্ট পান। সম্প্রতি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ৪৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্ল্যানও হয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হয়ে যাবে।”

এ দিকে, ব্লক এলাকায় সিন্দরি ও বামুনডিহায় যে দু’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে সেখানেও চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে মানুষজন সন্তুষ্ট নয়। সিন্দরি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক শ্যামকিঙ্কর কুইরি বলেন, “দেড় বছর আগে এক চিকিৎসক বদলি হয়েছেন। তাঁর পরিবর্ত চিকিৎসক না আসায় অন্তর্বিভাগ বন্ধ রাখতে হয়েছে। বামুনডিহা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও শুধুমাত্র অন্তর্বিভাগ চালু রয়েছে। সিন্দরি পঞ্চায়েতের প্রধান বিশ্বজিৎ মাহাতো বলেন, ঝাড়খণ্ড থেকেও এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী আসে। তাই অন্তর্বিভাগ চালুর জন্য বিভিন্নস্তরে আবেদন জানিয়েছিলাম। লাভ হয়নি।” বামুনডিহার বাসিন্দা কল্পনা কুম্ভকার বলেন, “কয়েকদিন আগে জ্বরে অসুস্থ মেয়েকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানকার ওষুধ খেয়ে কাজ দেয়নি। পরে চিকিৎসক বাজার থেকে ওষুধ কিনে খেতে বলেন। ওই ওষুধ কেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাওয়া যাবে না?” মাওবাদী নাশকতার সাক্ষী বেড়াদায় একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দাবি জানিয়েও পাওয়া যায়নি বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন স্থানীয় বাসিন্দা তথা বরাবাজার পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি প্রতুল মাহাতো।

বরাবাজারে এখনও নার্সিংহোম চালু হয়নি। কিছু ওষুধ দোকানে সপ্তাহের কয়েকটা দিন বাইরে থেকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসেন। কিন্তু, বাকি দিনগুলোয় ভরসা সেই হাতুড়েরাই। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার এই ফাঁক গলেই হাতুড়েদের উপর ভরসা অটুট এলাকায়। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাতোর আক্ষেপ, “বরাবাজারের বিভিন্ন গ্রামে আমরা অন্য কারও উপর ভরসা না করে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানুষকে যেতে আমরা প্রচার করি। কিন্তু তেমন সাড়া পাইনি। বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, বহুবারই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে তাঁরা চিকিৎসকের দেখা পান না।” তাঁর অভিযোগ, ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাইড্রোসিল অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে টাকা দিয়েছেন এমন নজির আছে। আবার টাকা দিতে চাননি বলে রোগীকে ছ’মাস পরে অস্ত্রোপচারের তারিখ দেওয়া হয়েছে। বিএমওএইচ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না বসে ওই চত্বরেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। “স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ থাকলে সাধারণ মানুষ ভরসা পাবেন কী ভাবে।”প্রশ্ন মধুসূদনবাবুর।

প্রশ্নটা অবশ্য বরাবাজারের আম জনতারও।

medical service barabajar amar shohor amar sohor samir dutta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy