Advertisement
E-Paper

স্নাতকে সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে শিক্ষামানের বিপদঘণ্টা

মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের পরে এ বার স্নাতক। প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে কলেজ স্তরেও ‘মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন’ বা এমসিকিউ শুরু করতে চলেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে শিক্ষাজগতে। শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করছেন, এতে ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর ঘরে এলেও ঘা খাবে শিক্ষামান।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৬

মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের পরে এ বার স্নাতক। প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে কলেজ স্তরেও ‘মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন’ বা এমসিকিউ শুরু করতে চলেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে শিক্ষাজগতে। শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করছেন, এতে ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর ঘরে এলেও ঘা খাবে শিক্ষামান।

এমসিকিউ পদ্ধতির ক্ষতিকর দিকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শিক্ষা শিবিরের একাংশ বলছেন, এতে বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ব্যাপারটাই নেই। সারা দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে গিয়ে আসলে পড়াশোনার ভিতরেই ঢুকতে পারছেন না এই রাজ্যের পড়ুয়ারা। স্কুলে ছোট প্রশ্নের ধাঁচ ইতিমধ্যেই বদলেছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে বেশি নম্বর পাওয়া পড়ুয়ার সংখ্যাও বেড়েছে। তবু গভীরতার ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।

রাজ্যে স্নাতক স্তরে এমসিকিউ চালু হচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরেই। সভা-বৈঠকে এক প্রকার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন, সময়ের দাবি মেনে আপাতত শুধু স্নাতক জেনারেল স্তরেই পরীক্ষার ধরন বদলানোর কথা ভাবা হয়েছে। অনেক শিক্ষাবিদের আশঙ্কা, সময়ের এই দাবি ক্রমে অনার্স স্তরেও ঢুকে পড়বে না তো!

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মে মাসের বৈঠকে ঠিক করেন বিএ, বিএসসি, বিকম জেনারেল পাঠ্যক্রমে প্রাধান্য পাবে অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন। প্রায় ৮০ শতাংশই হবে এমসিকিউ। দেশ জুড়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মূল্যায়ন হয় এই ধরনের প্রশ্নের ভিত্তিতেই। এ রাজ্যে স্কুল হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়— পরীক্ষায় বড় প্রশ্নের আধিক্যের দরুন পড়ুয়ারা অন্যান্য রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের মতো নম্বর পান না। দৌড়ে টিকে থাকার তাগিদেই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ এমসিকিউ বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। একই পথে হাঁটতে চায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এই প্রশ্ন-ব্যবস্থা শিক্ষারই পরিপন্থী বলে আপত্তি তুলছেন কিছু শিক্ষাবিদ।

পাশ কোর্সে এই ব্যবস্থা যদিও বা চলে, অনার্সে এটা কোনও মতেই সমর্থন করা যায় না বলে জানিয়েছেন আইআইএমের অর্থনীতির প্রাক্তন শিক্ষক অনুপ সিংহ। তাঁর বক্তব্য, এমসিকিউ ব্যাপারটাই গোলমেলে। এর বেশ কিছু সুবিধে আছে। যেমন, খাতা দেখতে সময় লাগে না। মেশিনেই ব্যাপারটা হয়ে যায়। ‘‘সকলেই জানে যে, পাশ কোর্সের খাতা সে-ভাবে দেখা হয় না। সে-ক্ষেত্রে এমসিকিউ হলে খাতা দেখার বিষয়টা অন্তত কিছুটা নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু অনার্সে প্রয়োজন গভীরতার। সেখানে দরকার পরিব্যাপ্ত পড়াশোনার। এমসিকিউ জ্ঞানের সেই ব্যাপ্তি মাপতে পারে না,’’ বলেন অনুপবাবু।

এটা ঠিক যে, এমসিকিউ-এর উত্তর দিতে হলে পুরো বইটাই খুঁটিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু কোন লাইন থেকে প্রশ্ন আসবে, সেই খুঁটে খাওয়ার প্রবণতা থেকে পুরো বই পড়তে গিয়ে পড়ুয়ারা আসলে বিষয়ের মধ্যে ঢুকতে পারেন না— এমনটাই অভিমত শিক্ষাবিদদের। শুধু তা-ই নয়, এমন উদাহরণও রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, লেখার অভ্যাস চলে যাওয়ায় অফিসকাছারির কাজের খসড়া করতে গিয়ে, এমনকী সামান্য অভিযোগপত্র লিখতে গিয়েও সমস্যায় পড়ছেন পাশ করা অনেক ছাত্রছাত্রী।

অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকার মনে করেন, কিছু কিছু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বাদ দিলে এই এমসিকিউ-এর উপকারিতা খুবই সীমিত। ‘‘একটা অঙ্ক অনেকে অনেক ভাবে করে। সাহিত্যের উত্তর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দিতে পারে বিভিন্ন পড়ুয়া। আমরা তো শুধু উত্তর জানতে পরীক্ষা নিই না। পড়ুয়াদের চিন্তা জানতে চাই। এমসিকিউ সেটা পারে না,’’ দীর্ঘ প্রশ্নোত্তর এবং এমসিকিউ-এর পার্থক্যটা এ ভাবেই দেখতে ও দেখাতে চাইছেন অভিরূপবাবু।

এমসিকিউ পদ্ধতির মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে চাইছেন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘পড়ার গভীরে যাওয়া দূর অস্ত্‌। এমসিকিউ ধাঁচে পড়তে গিয়ে পড়ুয়া অচিরেই ভুলে যায়, সে কী পড়েছে! পরীক্ষার পরেই বিষয়টি তার মাথা থেকেও হারিয়ে যায়।’’ বিতর্কের প্রায় উপসংহার-বাক্য শোনা গেল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের মুখে। তাঁর কথায়, এই ব্যবস্থা হয়তো প্রতিযোগিতায় ‘ফিটেস্ট’ পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়াবে। কিন্তু মেধার কোনও মূল্যই থাকবে না। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় এমন ক্ষেত্র, যেখানে পড়ুয়া বৃহত্তর পাঠ-পরিধির মধ্যে প্রবেশ করে। যে-কোনও বিষয় তাকে সার্বিক ভাবে জানতে হয়। ছোট প্রশ্নে যার মূল্যায়ন হতে পারে না। ‘‘এ ভাবে চললে চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বড় কিছু লিখতে হলে হিমশিম খায় অনেকে,’’ বলছেন আনন্দদেববাবু।

High secondary University Calcutta University MCQ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy