আট মাসে ১৬ একর। সাকুল্যে!
দু’টি সেতুর ‘কানেক্টর’ বানাতে সরাসরি কৃষকের থেকে এতটা জমি কিনেছে রাজ্যের পূর্ত দফতর। একেই ‘উদাহরণ’ হিসেবে তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী ফের চেয়েছেন, শিল্পোদ্যোগীরা যেন নিজেরাই জমি কিনে শিল্প গড়েন। গত ১৫ জুলাই বর্ধমানে রাজ্য সরকারের শততম প্রশাসনিক বৈঠকের মঞ্চ থেকে সম্ভাব্য লগ্নিকারীদের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শ— ভালবেসে, আদর করে নিজেরাই জমি কেনার উদ্যোগ নিন।
ঠিক যেমনটি করছে তাঁর সরকার। কী রকম?
রাজ্যের পূর্ত-সচিব ইন্দিবর পাণ্ডে সে দিনের বৈঠকে জানান, কৃষকের থেকে সরাসরি জমি কেনার লক্ষ্যে ভূমি দফতর একটি নীতি তৈরি করেছে, যার ভিত্তিতে পূর্ত দফতর ৪০টি প্রকল্পে জমি কেনার ছাড়পত্র দিয়েছে। এর দু’টোয় জমি কেনা সারা, বাকিগুলোর কাজ চলছে। পশ্চিমবঙ্গের এ হেন ‘জমি-নীতি’ সারা দেশের সামনেই ‘মডেল’ হওয়া উচিত বলে সে দিন দাবি করেন মমতা।
ঘটনা হল, গত চার বছর ইস্তক মুখ্যমন্ত্রী শিল্পমহলকে বারবার এই বার্তাই দিয়ে এসেছেন যে, তাঁর সরকার শিল্পের জমি অধিগ্রহণ করে তো দেবেই না, এমনকী জমি কিনতে সাহায্যও করবে না। সেই প্রসঙ্গে এখন তিনি ‘সরকারি প্রকল্পে সরকারি তরফে’ জমি কেনার দৃষ্টান্ত খাড়া করায় প্রশ্ন উঠেছে, একটা সেতু বা ছোট রাস্তার জন্য জমি কেনা আর শিল্পের জন্য জমি কেনা কি এক হল?
কেন এক নয়, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বণিকমহল বলছে, সাধারণত একটা বড় ইস্পাত প্রকল্প গড়তে এক-দেড় হাজার একর জমি লাগে। সিঙ্গুরে টাটাদের বাতিল হয়ে যাওয়া গাড়ি কারখানার জন্য ৯৯৭ একর বরাদ্দ ছিল। আবার অন্ডালে যে বেসরকারি বিমানবন্দরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী হাজির ছিলেন, সেখানে (উপনগরী-সহ) দু’হাজার একরের বেশি জমি নেওয়া হয়েছে। একাধিক শিল্প-কর্তার দাবি: উৎপাদনভিত্তিক বড় শিল্প গড়তে একলপ্তে বিস্তর জমি দরকার। কারণ অনুসারী শিল্পের সংস্থান করতে হয়, উপরন্তু সবুজায়ন-সহ বিভিন্ন কাজের বাধ্যবাধকতা থাকে।
এবং মুখ্যমন্ত্রীর ‘মডেল’ মোতাবেক শিল্প করতে হলে সংস্থাকে অত জমি নিজেই কিনতে হবে! পশ্চিমবঙ্গে সেটা কতটা সম্ভব?
নবান্ন-সূত্রের খবর, রাজ্য সরকারের ‘জমিব্যাঙ্ক’-এ বেশ ক’হাজার একর মজুত থাকলেও তা শিল্পের বিশেষ কাজে লাগছে না। কেননা সেখানে একলপ্তে বেশি জমি পাওয়া মুশকিল। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্র ছোট ছোট জোতের জমি। প্রশাসনের একাধিক আধিকারিকের বক্তব্য: পঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে এক মালিকের হাতে অনেক জমি থাকায় বেচা-কেনা তুলনায় সহজ। অথচ পশ্চিমবঙ্গে বেশি জমি মানেই বেশি মালিক। যেমন সিঙ্গুরে ৯৯৭ একরের মালিক-সংখ্যা ছিল প্রায় ২৯০০!
এই সমস্যার কারণেই এখানে বড় শিল্পের জন্য রাজ্য সরকার বরাবর জমি অধিগ্রহণ করে দিয়েছে। ‘‘সরকার পাশে না-দাঁড়ালে সিঙ্গুর বা বিমাননগরীর জমি পাওয়া সম্ভবই হতো না,’’— বলছেন শিল্প-বণিকমহলের একাধিক কর্তা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে এত এত জমি নিজেরা কিনে শিল্প করতে হলে গোড়াতেই ঘা খেতে হবে।’’ ছোট জোতের পাশাপাশি জমি কেনার অন্তরায় হিসেবে তোলাবাজি, মধ্যসত্ত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের দাপটের দিকেও আঙুল উঠেছে।
নবান্নের অনেকের মতে, সরকারি প্রকল্পের জমি কেনা সংক্রান্ত ভূমি দফতরের বিজ্ঞপ্তিটির মধ্যেও রয়েছে সঙ্কটের আভাষ। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সামান্য জমির অভাবে রাস্তা, সেতু বা খাদ্য-গুদামের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো-প্রকল্প চালু করা যাচ্ছে না। সেগুলির দ্রত রূপায়ণে কৃষকের থেকে সরাসরি জমি কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভূমি দফতরের খবর, এই প্রকল্পগুলির অধিকাংশই সেতু-সংযোগকারী রাস্তা, উড়ালপুল বা বাসস্ট্যান্ড। যাতে জমি লাগবে বড়জোর আট-দশ একর করে। কিন্তু সেটুকু কিনতেই সরকারের নাভিশ্বাস! নবান্নের খবর, জমি কিনতে ভূমি দফতর বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল গত ২৪ নভেম্বর। আট মাসে মাত্র দু’টো প্রকল্পে ১৬ একরের মতো কেনা গিয়েছে। সেতু-সংযোগী রাস্তা হবে সেখানে।
এই অবস্থায় প্রশাসনের কর্তারাই প্রকল্পগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। কারণ, বীরভূমে দ্বারকা নদীর সেতু ও রাস্তার জন্য ৪৭ একর কিনতে হবে। বর্ধমানে ভাতার-সামন্তী রাস্তা গড়তে চাই ৪৫ একর। গঙ্গাসাগরে বাসস্ট্যান্ড বানাতে ৭১ একর লাগবে। ‘‘১৬ একর কিনতে যদি ৮ মাস লেগে যায়, সব প্রকল্পের সব জমি কবে জোগাড় হবে, আন্দাজই করতে পারছি না!’’ স্বীকারোক্তি এক আধিকারিকের।
বণিকসভার অনেকে বলছেন, এ রাজ্যে শিল্পের জন্য জমি কেনা এখন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। সাঁকরাইলে একটি প্রকল্পে দরকার ছিল ৩০ একর। বহু চেষ্টাতেও তা কিনতে না-পেরে হাল ছেড়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। জমি না-পেয়ে খড়্গপুরে এক কারখানার সম্প্রসারণ লাটে। বেশ কিছু শিল্পসংস্থার অভিযোগ, এখানে জমি কিনতে দালালের সাহায্য নিতেই হয়। আর তা করতে গিয়ে শাসক দলের একাধিক গোষ্ঠীর দাদাগিরির দাপটে শেষমেশ প্রকল্পই গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে। ‘‘প্রশাসন সব জানে। তবু প্রত্যেকেই যেন অসহায়!’’ আক্ষেপ করেছেন শিল্পমহলের কেউ কেউ।
এই অবস্থায় রাজ্য প্রশাসনের কর্ণধারের মুখে শিল্পের জমি কিনে নেওয়ার ‘সহজ’ দাওয়াই শুনে ওঁরা বিস্মিতও কম নন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy