বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনর্নিয়োগ রদের সিদ্ধান্তে সরকার কতটা অবিচল এবং এই বিষয়ে তারা কত ‘শক্ত পদক্ষেপ’ করতে তৈরি, শুক্রবারেই তার প্রমাণ মিলল। অবসরের পরের দিনই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে তাদের তিন শিক্ষককে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, শুক্রবার উপাচার্যের কাছে তা জানতে চায় উচ্চশিক্ষা দফতর।
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যে রীতিমতো কৈফিয়ত তলব করা হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি জানান, যাদবপুরের এই পদক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। ‘‘ওখানকার উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে। কোনও অবস্থাতেই সরকার এ-সব মানবে না। এর জন্য (পুনর্নিযুক্ত তিন শিক্ষকের বেতনের জন্য) টাকাও দেওয়া হবে না। নির্দেশ না-মানলে সরকার ব্যবস্থা নেবে,’’ বলেন মন্ত্রী।
পুনর্নিয়োগের ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনই সরব। তবে এই নিয়ে যাদবপুরই প্রথমে সরকারের সঙ্গে সংঘাতের রাস্তায় নেমেছে। শিক্ষামন্ত্রী ১৭ নভেম্বর পুনর্নিয়োগ রদের কথা জানান। সেই ঘোষণা সত্ত্বেও ৩০ নভেম্বর অবসরের পরে পদার্থবিদ্যার অপরাজিতা ভট্টাচার্য, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুজিত বিশ্বাস এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক অমিতাভ সরকারকে ১ ডিসেম্বরই পুনর্নিয়োগ দেয় যাদবপুর। তারা জানায়, ওই তিন শিক্ষককে ‘প্রফেসর ইন রেসিডেন্স’ হিসেবে আপাতত তিন মাস বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্মসমিতি। শুধু তা-ই নয়, সরকার তাঁদের বেতন না-দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ই সেই টাকা জোগাবে বলে জানানো হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী তথা সরকারের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে যাদবপুরের এই মনোভাব। উচ্চশিক্ষা দফতরের এক কর্তার মতে, কোনও অবস্থাতেই অবসরের পরে শিক্ষকদের এ ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে দেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় এই ভাবে বেতনও দিতে পারে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনও টাকা নেই। সবটাই জনগণের টাকা।
এই পরিস্থিতিতেই উচ্চশিক্ষা দফতর যাদবপুর-কর্তৃপক্ষের কাছে এ দিন জানতে চেয়েছে, ওই তিন শিক্ষককে রেখে দেওয়া হল কী ভাবে? উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর,
তাদের এক কর্তা সরাসরি উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের কাছে জানতে চান, পুনর্নিয়োগ রদের নির্দেশ জারির পরেও ওই তিন জনের পুনর্নিয়োগ হল কী করে? এবং কী ভাবে এটা বলা হল যে, ওই শিক্ষকদের বেতনের ব্যবস্থা করবে বিশ্ববিদ্যালয়ই?
জবাবে উপাচার্য কী বলেছেন, তা জানা যায়নি। কারণ, বক্তব্য জানতে এ দিন বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা সত্ত্বেও সুরঞ্জনবাবুকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে যাদবপুরের রেজিস্ট্রার প্রদীপকুমার ঘোষ জানান, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ওই তিন শিক্ষককে যে পুনর্নিয়োগ দেওয়া যাবে না, সেটা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার পরে কর্মসমিতিতে সিদ্ধান্ত হয়, তিন শিক্ষককে আপাতত তিন মাসের জন্য রেখে দেওয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের স্বার্থেই।
উচ্চশিক্ষা দফতরের এক কর্তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কাজ করার এক্তিয়ারই নেই। ১৯৭৯-র একটি সার্কুলার অনুযায়ী অবসর নেওয়ার পরে শিক্ষকদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি-সহ যাবতীয় পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হবে। তার পরে আবেদন করলে বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে তাঁকে পুনর্নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এবং ফের বহাল হলে বেতন মিলবে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী। বিশ্ববিদ্যালয় কোনও ভাবেই বলতে পারে না যে, তারা পুনর্নিযুক্ত শিক্ষকদের টাকা জোগাবে।
শিক্ষা শিবিরের একাংশের মতে, এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে টাকার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। কেননা স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত বিতর্কে খোদ শিক্ষামন্ত্রী একাধিক বার বলেছেন, সরকার তো বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা জোগায়। সেই জন্যই তারা সেখানকার সমস্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে। সেই বিতর্কের মধ্যেই এসে পড়েছে পুনর্নিয়োগ-সংঘাত। এবং যাদবপুর তাতেও টাকা দেখানোয় ক্ষোভ বেড়েছে রাজ্যের।
শিক্ষক সংগঠন কর্মবিরতিতে নামার আগে তাঁর সঙ্গে আলোচনা না-করায় শিক্ষামন্ত্রী আগেই এক প্রস্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। সরকারের সঙ্গে যাদবপুরের সংঘাতের মধ্যেই এ দিন ঘোষণা অনুযায়ী পুনর্নিয়োগ স্থগিতের সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে কর্মবিরতি পালন করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ। কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিল ওয়েবকুটা, আবুটা-সহ রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষক সংগঠন। তবে বেশ কিছু ক্লাস হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাস হচ্ছে কি না, ঘুরে ঘুরে তা দেখেছেন রেজিস্ট্রার সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েকটি ক্লাস হয়েছে রবীন্দ্রভারতীতেও। এবং পরীক্ষাকে কর্মবিরতির বাইরে রাখা হয়েছিল সব বিশ্ববিদ্যালয়েই। কলকাতা এবং কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নাক’ পরিদর্শনে আসবে আর কিছু দিনের মধ্যেই। সেই পরিদর্শনের প্রস্তুতিকেও কর্মবিরতির বাইরে রাখা হয়েছিল।