E-Paper

মাথায় হাত থাকলেই ফেল যাবতীয় কমিটি

রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ফিরেছে হুমকি-প্রথা। প্রবল দাপটে। আর জি কর আন্দোলনের বছর ঘোরার মুখে কী বদলাল তা হলে?

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৫ ০৭:১৮

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ডিউটি রুমে বসে গাঁজায় টান দিচ্ছেন এক ইন্টার্ন। সেই ছবি ছড়িয়েছে কলেজ জুড়ে। তাঁর সতীর্থরা লিখিত অভিযোগ করছেন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। জানাচ্ছেন, এমন পরিবেশে তাঁদের কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। বার বার এমন ঘটলে রোগী বা তাঁদের পরিবারের হাতে তাঁরা নিগৃহীত হবেন— এমন শঙ্কাও প্রকাশ করছেন। তদন্ত শুরু হচ্ছে। তার পর? কলেজের এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘মাথায় দাদা-দিদিদের হাত থাকলে কোনও তদন্ত কমিটির ক্ষমতা নেই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সেটা এরা বুঝে গিয়েছে। তাই এমন বেপরোয়া ভাব।’’

দলের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য থাকবে। বিনিময়ে পেতে হবে স্বেচ্ছাচারের স্বাধীনতা! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা মিলেও যাচ্ছে। রাজ্য জুড়ে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তাই লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে বিষবৃক্ষের চারা। হাসপাতাল চত্বরের ভিতরে, এমনকি ডিউটি রুমে বসে মদ, গাঁজা খাওয়াই শুধু নয়, চলছে মহিলাদের সঙ্গে অশালীন আচরণও। কোথাও মেডিক্যাল পড়ুয়ারা হেনস্থার শিকার। আবার কোথাও ‘টার্গেট’ হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে নার্স, বিভিন্ন বিভাগের তরুণী টেকনিশিয়ানদের। সম্প্রতি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এমনই অভিযোগ জমা পড়েছে এক ইন্টার্নের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ওই ইন্টার্ন টেকনিশিয়ান কোর্সের এক পড়ুয়াকে যৌন হেনস্থা করেছেন। ওই তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তও শুরু হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, ওই ইন্টার্ন প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছেন, কী ভাবে এই সব কমিটির তদন্ত বানচাল করা যায়, তা তাঁর বিলক্ষণ জানা আছে।

এখানেই শেষ নয়। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজেই এক ইন্টার্ন দিনের পর দিন ডিউটিতে না এসেও হাজিরা খাতায় সই করে চলেছেন। অভিযোগ, মাসের শুরুতেই তিনি প্রায় গোটা মাসের হাজিরা সই করে দেন। বিষয়টি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে এলে শো-কজ় করা হয়। অভিযোগ, এর পর পাল্টা কর্তৃপক্ষকেই হুমকি দিয়েছেন ওই ইন্টার্ন। কলেজের প্রিন্সিপাল, ডিনদের ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বলে প্রকাশ্যে বিদ্রুপ করা, এমনকি তাঁদের নিজের ‘এক্তিয়ার’ স্মরণ করিয়ে দেওয়াও চলছে প্রকাশ্যে। স্বাস্থ্য ভবন জানে না কিছু? জানে। অভিযোগ, ‘‘ও সব স্থানীয় স্তরের সমস্যা। স্থানীয় স্তরেই মেটানো হবে’’ বলে দায়িত্ব এড়িয়েছেন কর্তারা।

অভিযোগ, জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে এক প্রবীণ চিকিৎসককে এক জুনিয়র ডাক্তার দিন কয়েক আগে বলেছেন, ‘‘ঘাড়ধাক্কা খেতে না চাইলে চুপচাপ থাকুন।’’ চোখের জল ফেলতে ফেলতে কলেজ চত্বর থেকে বেরিয়েছিলেন ওই চিকিৎসক। সেই দৃশ্যের অবতারণা সকলের অন্তরালে তো ঘটেনি।

অভিযোগ, রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষের ঘরেই মাঝেমধ্যে বসছে সালিশি সভা। সেখানে কথা না শোনা ‘বেয়াড়া’ ডাক্তারদের বিচার হয়। কর্তৃপক্ষ অবশ্য এটাকে ‘আজগুবি কথা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেই সালিশি সভার ভিডিয়ো সেখানে প্রায় ভাইরাল। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা ইন্দ্রজিৎ সাহা অবশ্য বলেছেন, ‘‘হুমকি সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ পাইনি।’’

আর জি করের ঘটনার পরে মাঝখানে কিছু দিন চুপচাপ থেকে স্বাস্থ্যে এখন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গ লবি। এর আগে উত্তরবঙ্গ লবির মাথা হিসেবে যাঁদের নাম সামনে এসেছে, সেই শ্যামাপ্রসাদ দাস, সুশান্ত রায়রা এখনওকলকাঠি নেড়ে চলেছেন বলে অভিযোগ প্রায় সর্বত্রই। শ্যামাপ্রসাদ অবশ্য বলেছেন, ‘‘সব সাজানো অভিযোগ। এখন বরং উল্টোটা চলছে। যাঁরা হুমকির শিকার হতেন, তাঁরাই হুমকি দিচ্ছেন।’’ হুমকি যে দেওয়া হত, সেটা তা হলে মেনে নিচ্ছেন তাঁরা? তাঁর জবাব, ‘‘আমি কোনও সাতেপাঁচে থাকি না। এ নিয়ে কিছু বলব না।’’ আর সুশান্তকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, তাঁর জবাব, ‘‘উত্তরবঙ্গ লবি! সেটা আবার কী বস্তু! আমি কোনও কিছুর মধ্যেই নেই। অবসরজীবন কাটাচ্ছি। কোনও ঝুটঝামেলায় থাকি না।’’ তা হলে বার বার তাঁর নামটাই সামনে আসছে কেন? তাঁর উত্তর, ‘‘গণতান্ত্রিক দেশ। কেউ কিছু বললে আটকাবকী ভাবে?’’

আর জি করের ঘটনার দিন তিনি অকুস্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন কেন? ‘অবসরজীবন’ যাপনের সঙ্গে এটার যোগ কোথায়? সেই প্রশ্নের অবশ্য কোনও উত্তর মেলেনি।

বিভিন্ন হাসপাতালে, মেডিক্যাল কলেজে এখন আর একটা ছবিও নজরে পড়ে। যাঁরা আগে এই হুমকি প্রথার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, আর জি করের ঘটনার পর তাঁরা কেউ কেউ এ সব থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। কিন্তু চেষ্টা করেও তা পারছেন না বলে দাবি। এক চিকিৎসক হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘‘যে ভাবে মাফিয়া দলে এক বার নাম লেখালে আর ফেরার উপায় থাকে না, ওঁদের অবস্থাটা অনেকটা সে রকমই। ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি!’’

তা হলে আর জি কর আন্দোলনের পর কী বদলটা এল? সরকারি তরফে গ্রিভান্স রিড্রেসাল কমিটি গড়া হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে। সেই কমিটির ভূমিকা কী? হুমকির মুখে পড়া চিকিৎসকেরা কি ওই কমিটির কাছে আসছেন, না কি সেই আস্থাটাই তৈরি হয়নি? কমিটির চেয়ারম্যান চিকিৎসক সৌরভ দত্ত বললেন, ‘‘কয়েকটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে আমাদের কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগ এসেছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কলেজের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি। কোনও কলেজে কাউকে কোনও ভাবে দাদাগিরি করতে দেওয়া হবে না।’’

কিন্তু দাদাগিরি করতে দেওয়া, না-দেওয়ার অপেক্ষা আর কে করছে? দাদাগিরিই তো ট্র্যাডিশন। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Medical Colleges West Bengal government Threat Culture in Education Threat Culture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy