E-Paper

শিক্ষায় এবং কাজে এগোচ্ছেন মেয়েরা, পাল্টা মারছে পিতৃতন্ত্র

২০২২-এর এনসিআরবি রিপোর্টে ২০২১-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষণের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দশ নম্বরে। নথিভুক্ত ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১১২৩। সেই সঙ্গে ১১টি নথিভুক্ত ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কলকাতা ছিল দেশের ১৯টি বড় শহরের মধ্যে ‘নিরাপদতম’।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৫ ০৭:০৩

—প্রতীকী চিত্র।

বছর ঘুরতে চলল। গত অগস্টে আর জি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল ছিল বাংলা। এ বছর অগস্ট আসার আগেই দক্ষিণ কলকাতা আইন কলেজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কিচ্ছুটি বদলায়নি।

না কি বদলেছে? ২০২২-এর এনসিআরবি রিপোর্টে ২০২১-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষণের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দশ নম্বরে। নথিভুক্ত ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১১২৩। সেই সঙ্গে ১১টি নথিভুক্ত ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কলকাতা ছিল দেশের ১৯টি বড় শহরের মধ্যে ‘নিরাপদতম’। সার্বিক ভাবে মহিলাদের প্রতি হিংসার মাপকাঠিতে কলকাতা ছিল দু’নম্বরে। পরবর্তী সংখ্যাতত্ত্ব যাই বলুক না কেন, আর জি কর এবং আইন কলেজের অন্দরে ঘটে যাওয়া দু’দু’টি ঘটনা কলকাতার ভাবমূর্তি অনেকাংশে তছনছ করে দিয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, বরাহনগর, কাটোয়া, ধূপগুড়ি, নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগণা— পরের পর ঘটনা ধর্ষণকে খবরের শিরোনামে রেখে যাচ্ছিল। খোদ মহানগরের বুকে প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা কোথায় ঠেকেছে, আর জি কর এবং আইন কলেজ তার সাক্ষী।

এমতাবস্থায় দেশের অন্যান্য অংশের অবস্থাটা কেমন, সেটার সুলুক-সন্ধানের চেষ্টায় বেছে নেওয়া হয়েছিল তিনটি রাজ্য— একটি গোবলয়ের (মধ্যপ্রদেশ), একটি দক্ষিণের (তামিলনাড়ু) এবং একটি উত্তর-পূর্বের (নাগাল্যান্ড)। সামগ্রিক ভাবে সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, ধর্ষণ-ধর্ষণের চেষ্টা-যৌন নিগ্রহের ঘটনা দেশ জুড়েই ঊর্ধ্বমুখী। শুধু জুন মাসেই ওড়িশায় দশ দিনের মধ্যে পাঁচটি ধর্ষণের অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়েছে। কোন সূত্রে মিলবে এর ব্যাখ্যা?

তামিলনাড়ুর নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখ ভি গীতা জোর দিলেন একটি শব্দে— প্রতিঘাত। তাঁর মতে, ভারত অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক দিকে মেয়েদের দৃশ্যমানতা ক্রমশ বাড়ছে। শিক্ষায়, কাজকর্মে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। শরীরী ভাষায় আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। যত বদলাছে, পিতৃতন্ত্রের চোয়াল তত শক্ত হচ্ছে। ক্রোধ, ঘৃণা, হতাশার বিকট বিস্ফার গিয়ে পড়ছে মেয়েদের উপরে। শিল্পক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। সেখানকার উৎপাদন শিল্পে এখন ৪৩ শতাংশই মহিলা কর্মী। মেয়েদের এই অগ্রসরণের চিত্র সর্বত্র সমান নয় অবশ্যই। ঠিক যেমন অর্থনৈতিক মানচিত্রও অঞ্চলভেদে আলাদা। রোজগারের অনিশ্চিতি, কর্মসংস্থানের অভাব সামাজিক বাঁধনগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন মধ্য ও পশ্চিম ভারতে জনজাতি এবং দলিতদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের নেত্রী মাধুরী কৃষ্ণস্বামী। তাঁর মতে, মেয়েদের প্রতি হিংসা বৃদ্ধি সেই রোগের উপসর্গ।

উপসর্গ। রাজ্যে রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসন-সমাজকর্মীদের বড় অংশ চিহ্নিত করছেন আরও দু’টি উপসর্গকে। নেশার রমরমা আর মোবাইল ফোন। মেয়েদের প্রতি গার্হস্থ্য হিংসাই হোক কিংবা যৌন নির্যাতন— নেশাসক্তির ভূমিকা উঠে আসে বারবার। অথচ সিকিম কিংবা গোয়ার মতো রাজ্যেও মদ্যপানের বহুল রেওয়াজ আছে। ধর্ষণের সংখ্যা সেখানে কিন্তু অনেক কম। সামাজিক সুস্থিতির অভাব যেখানে প্রবল, নেশার ভূমিকা সেখানেই দৈত্যাকার। ঠিক যেমন মোবাইল ফোন। মধ্যপ্রদেশের ডিজিপি কৈলাস মাকওয়ানা সম্প্রতি দাবি করেছেন, একা পুলিশের পক্ষে ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব নয়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যত সহজে যে পরিমাণ পর্নোগ্রাফি হাতে হাতে পৌঁছচ্ছে এবং সেটা সমাজমনে যে প্রভাব ফেলছে, সেটা পুলিশের পক্ষে নিবারণ করা অসম্ভব। সমাজকর্মীরাও বলছেন— যে প্রযুক্তি যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব এনেছে, যে প্রযুক্তি সমাজমাধ্যমের সুবাদে মত প্রকাশের পরিসর বাড়িয়েছে, সেই একই প্রযুক্তি মেয়েদের পণ্যায়ন বাড়িয়েছে। সামাজিক অসাম্যকে প্রকটতর করেছে, বিদ্বেষ-হিংসা-ঘৃণার চাষ করেছে এবং পিতৃতন্ত্রের হাতশক্ত করেছে।

নবশক্তিতে বলীয়ান পিতৃতন্ত্রের এই দাপটকে অনেকেই সরাসরি সংযুক্ত করছেন মৌলবাদী আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে। আইনজীবী বিএস অজিতা বলছিলেন, সংখ্যাগুরুর পিতৃতন্ত্রে কিন্তু সংখ্যালঘুর পিতৃতন্ত্রও জোরদার হয়। এক মৌলবাদ অপরাপর মৌলবাদকেও ঘর গোছাতে প্রণোদিত করে। মেয়েদের দাবিয়ে রাখার ইচ্ছা এবং মেয়েদের ভোগ্যপণ্য মনে করার ইচ্ছা, একই মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠ। অজিতার কথায়, ‘‘অসবর্ণ বিয়ের সংখ্যা কমছে। তফসিলি জাতিদের মধ্যেও মর্যাদার নামে খুন-খারাপি বাড়ছে। তামিলনাড়ুতে দেখছি, বামপন্থী-পেরিয়ারপন্থীদের প্রভাব ক্রমশ ক্ষীয়মাণ। মেয়েদের প্রতি হিংসার বাড়বৃদ্ধিকে এগুলোর থেকে আলাদা করে দেখা চলে না।’’ অজিতার সঙ্গে মিলে গেল ভোপালে গ্যাসদুর্গতদের অধিকার নিয়ে কাজ করে চলা রচনা ধিংড়ার বক্তব্য। রচনা বললেন, ‘‘কুড়ি বছর আগের ভোপালকে এখনকার সঙ্গে মেলাতে পারি না। যে ধরনের ধর্মীয় মেরুকরণ ‘স্বাভাবিক’ হয়ে পড়ল, সেটা আগে দেখিনি। হিন্দু হোক কি মুসলিম মহল্লা, ধর্মগুরুদের কথকতা লেগেই আছে। আর সকলেরই বক্তব্য এক— মেয়েদের কী করা উচিত, মেয়েদের কী না করা উচিত।’’

এই রকম সামাজিক আবহে শুধু আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ধর্ষণের প্রতিরোধ সম্ভব? পরিবারের মধ্যে, বন্ধুবর্গের মধ্যে, পরিচিত বৃত্তের মধ্যে থেকেও মুহূর্মুহূ আক্রমণ আসে— নিরাপদ বলয়ের ধারণাটাই অস্পষ্ট হয়ে যায়। সমাজের বিষ দূর করার তাগিদ তাই সমাজের ভিতর থেকে উঠে আসতে হবে বলে মনে করছেন সমাজকর্মীদের একাংশ। কিন্তু পাল্টা বয়ান তৈরির সেই সুযোগও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। ভি গীতা সখেদে বলছিলেন, মৌলবাদ-অধ্যুষিত বলদর্পী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সামাজিক আন্দোলনেরপরিসরটা দিনকে দিন সংকুচিতহয়ে যাচ্ছে। দিল্লির নির্ভয়া আন্দোলন এবং কলকাতার রাত দখল আন্দোলন সামনে থেকে দেখেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যার অধ্যাপক মল্লারিকা সিংহ রায়। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, অসমের চা শ্রমিক, কেরলের কফি শ্রমিক মেয়েরাও কিন্তু রাত টহল করে এসেছেন দীর্ঘ দিন। তাঁর কথায়, ‘‘আইনি বিবর্তন, শৃঙ্খলা ব্যবস্থার সম্প্রসারণও বহুলাংশে সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত। একটা সময় মনে হচ্ছিল, মেয়েদের আন্দোলন রাস্তার আন্দোলন থেকে কিছুটা সরে গিয়েছে। নির্ভয়া আন্দোলন তাকে আবার রাস্তায় ফিরিয়ে দেয়। সেই আন্দোলনেরই ফসল ছিল বর্মা কমিটির রিপোর্ট এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন বদল।’’

আর মন বদল? অজিতা বললেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে লিঙ্গচেতনা কখনও তৃণমূল স্তরে পৌঁছবে না। শুনে মনে পড়ে গেল মধ্যপ্রদেশের সমাজকর্মী প্রার্থনা শর্মার জিজ্ঞাসা, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামে আশা কর্মী পৌঁছতে পারেন, লাডলি বহেনার টাকা পৌঁছতে পারে, মিড ডে মিল পৌঁছতে পারে। হিংসার ঘটনা ঘটলে মেয়েরা কোথায় কী কী সাহায্য পেতে পারেন, সেই তথ্য পৌঁছয় না কেন?’’ মন বদলাতে হলে বুনিয়াদি স্তর থেকেই তা শুরু হওয়া প্রয়োজন। মল্লারিকা বললেন, ‘‘ছোটদের তো শেখানো হয়, আগুনে হাত দিলে হাত পোড়ে। মেয়েদের নির্যাতন করার ফলও যে ততটাই ক্ষতিকারক হতে পারে, এই বোধটা শৈশব থেকে তৈরিহওয়া দরকার।’’

যত দিন তা না হচ্ছে, ধর্ষকের চারণভূমিই আমার দেশ!

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

rape cases Women Harassment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy