Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Duttapukur Blast

‘লাইসেন্স মিলে যাবে’ ঘোষণার পর কি শুরু বাজির কারবার? রাতারাতি কারখানা চালু হওয়া নিয়ে প্রশ্ন

পুলিশ সূত্রের খবর, একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে রাজ্যে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ২৭টি ঘটনায় ৯০ জন মারা গিয়েছেন।

An image of Fire Crackers

বাজি-ঘর: বিস্ফোরণস্থলের অদূরে একটি কারখানায় মজুত রয়েছে বাজি। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৩ ০৫:০৮
Share: Save:

হঠাৎ করেই প্রবল তৎপরতা শুরু হয়েছিল গত তিন দিন ধরে। অভিযোগ, বাজি নিয়ে সরকারি ‘ছাড়পত্র’ মিলতে চলেছে ‘খবর’ থাকায় সপ্তাহখানেক আগে থেকেই রাতের অন্ধকারে প্রয়োজনীয় জিনিস মজুত করা চলছিল। তৈরি হওয়া সেই বাজি শুকিয়ে ঘরের ভিতরে মজুত করার সময়েই রবিবার সকালে ঘটে বিস্ফোরণ। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শিশু-সহ অন্তত সাত জনের দেহ। আহত হন অনেকে।

দত্তপুকুর থানা এলাকার নীলগঞ্জের মোচপোলের এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, কী এমন ঘটল, যার জন্য বন্ধ থাকা বেআইনি বাজি কারখানা রাতারাতি চালু হয়ে গেল? উত্তর ২৪ পরগনার বাজি ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, শুধু বিস্ফোরণস্থলেই নয়, গত কয়েক দিনে রাজ্যের একাধিক জায়গায় খুলে গিয়েছে বাজির বন্ধ কারখানা। তাঁদের দাবি, গত বুধবার সরকারি অনুষ্ঠান থেকে রাজ্যের পাঁচ জায়গায় ক্লাস্টার তৈরি এবং বাজি ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়ার জন্য ওয়েবসাইট উদ্বোধনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তাতেই অনেকে ভেবেছেন, সরকার যখন লাইসেন্স দেওয়ার ঘোষণা করেই দিয়েছে, তখন বাজি তৈরিতে বাধা নেই। পুজোর মুখে বসে থেকে লাভ কী? উত্তর ২৪ পরগনার এক বাজি ব্যবসায়ীর মন্তব্য, ‘‘এতেই বিপদ মাথায় করে বাড়ির ভিতরে রাতারাতি বাজির কারবার শুরু হয়ে গিয়েছে।’’

পরিবেশকর্মী তথা ‘সবুজ মঞ্চ’-এর আহ্বায়ক নব দত্ত বলেন, ‘‘রাতারাতি ক্লাস্টার এবং লাইসেন্স পেতে ওয়েবসাইটের ঘোষণার মাধ্যমে বাজি তৈরিকে সিলমোহর দিয়ে বিপদ ডেকে আনা হয়েছে।’’ ‘পশ্চিমবঙ্গ বাজি শিল্প উন্নয়ন সমিতি’র সম্পাদক শুভঙ্কর মান্নারও দাবি, ‘‘সরকারি মঞ্চ থেকে যে ভাবে বাজি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতার নাম ঘোষণা হয়েছে এবং তিনি যে ভাবে বাজির লাইসেন্সের ব্যাপারে ভুল প্রচার চালাচ্ছেন, তাতে এমন হতে বাধ্য। এগরার খাদিকুল বা মহেশতলার নন্দরামপুরের ঘটনার পর যে চাপ ছিল, এখন সেটা উধাও।’’

পুলিশ সূত্রের খবর, একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে রাজ্যে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ২৭টি ঘটনায় ৯০ জন মারা গিয়েছেন। বর্তমান সরকারের আমলেই মৃত্যু হয়েছে ৭৬ জনের। পঙ্গু হয়েছেন ৩৬ জন। মৃতদের তালিকায় বেশির ভাগই মহিলা এবং শিশু। এই সূত্রেই উঠে আসছে, ১৯৯৫ সালে বাগনানের হাতুড়িয়ায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে ১৩ জন শিশুশ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনা। কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এস বি সিংহ নির্দেশ দিয়েছিলেন, নিহত শিশুশ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং সমস্ত অবৈধ বাজি কারখানা বন্ধ করতে হবে। অভিযোগ, সেই নির্দেশ যে মানা হয়নি, তার প্রমাণ মেলে ২০১৫ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায়। সেখানে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত হয় সাত শিশু।

‘আতশবাজি উন্নয়ন সমিতি’র চেয়ারম্যান বাবলা রায়ের যদিও দাবি, ‘‘বারাসতের ওই জায়গার বিষয়ে পুলিশকে আগেই জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা পদক্ষেপ করেনি। ওখানে বাজি, না কি অন্য কিছু ছিল, তা-ও দেখা দরকার। তবে এর জন্য সবাইকে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। হাজার হাজার বাজি কারখানায় কয়েক লক্ষ কর্মী কাজ করেন, তাঁদের কর্মসংস্থানের কী হবে?’’ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে যদিও জানা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে কোনও দিনই শতাধিক বাজি কারখানা আইনসম্মত ছিল না। ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত পর্ষদের লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাজি কারখানা ছিল ২৪টি। যদিও গত অক্টোবরে পর্ষদ জানিয়ে দেয়, রাজ্যের কোনও বাজি কারখানাতেই সবুজ বাজি তৈরি হচ্ছে না। তাই কোনও কারখানাই বৈধ নয়। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে হাজার হাজার কারখানায় কয়েক লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের যুক্তি টেকে কী ভাবে?

পরিবেশকর্মীদের আরও প্রশ্ন, সুপ্রিম কোর্ট (১১ ডিসেম্বর, ২০১৮) যেখানে দেশে সারা বছরে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা সবুজ বাজি ফাটানোর সময় বেঁধে দিয়েছে, সেখানে সারা বছর বাজি তৈরি করে কী হবে? তবে কি এমন বাজি কারখানার আড়ালে বিস্ফোরক নিয়ে অন্য কিছু হয়? নীলগঞ্জের কারখানাটির চিত্র দেখেও সামনে আসছে সে-ই প্রশ্ন— সেখানে কি শুধুই বাজি তৈরি হচ্ছিল? পরিবেশকর্মীদের দাবি, বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মামলায় জাতীয় পরিবেশ আদালত ২০১৫ সালের নভেম্বর এবং ২০১৬-র অগস্টে দু’টি নির্দেশে স্পষ্টই বলেছে, রাজ্যে বাজি কারখানার আড়ালে বোমা তৈরি হয় এবং কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় প্রচুর বেআইনি বাজি কারখানা চলছে।

প্রশাসন কড়া হবে কবে? সাত বছর পরেও স্পষ্ট উত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Blast Fire Cracker Factory
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE