E-Paper

কেষ্টর কুকথা: নীরব রাজ্য মহিলা কমিশন

বোলপুরের আইসি এবং তাঁর পরিবারকে জড়িয়ে কুকথা বলা ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগে অনুব্রতের বিরুদ্ধে পুলিশ কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চেয়ে বৃহস্পতিবারই রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারকে চিঠি দিয়ে ‘অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট’ চেয়েছিল জাতীয় মহিলা কমিশন।

রাজীব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৫ ০৭:৪৮
অনুব্রত মণ্ডল।

অনুব্রত মণ্ডল। —ফাইল চিত্র।

থানার এক পুলিশ ইনস্পেক্টরের স্ত্রী ও মায়ের উদ্দেশে বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের (কেষ্ট) মন্তব্য নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার ঢেউ গিয়ে পড়েছে দিল্লিতেও। ওই ঘটনায় ইতিমধ্যেই রাজ্য পুলিশের রিপোর্ট তলব করেছে জাতীয় মহিলা কমিশন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল, স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের তো দূরের কথা, এখনও পর্যন্ত ওই মন্তব্যের আনুষ্ঠানিক নিন্দাটুকুও করেনি রাজ্য মহিলা কমিশন। এই নীরবতা ফের এক বার সংস্থার নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। যদিও কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের যুক্তি, পুলিশ ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে মামলা করায় তাঁদের কাছে পৃথক ভাবে তদন্ত করার সুযোগ আর নেই। তাঁর দাবি, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হল, একই ঘটনায় দু’টি সংস্থা পৃথক ভাবে তদন্ত করতে পারে না।”

এই প্রথম নয়। আগেও একাধিক ঘটনায় কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের অভিযোগ নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বঙ্গসমাজকে। সে ক্ষেত্রেও প্রথম দিকে মৌনী ছিল কমিশন। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় পরে লীনা-সহ কমিশনের কয়েক জন সদস্যা সন্দেশখালি গিয়েছিলেন। অনুব্রতের মন্তব্যের নিন্দা কি করা যেত না? লীনার জবাব, “এই মন্তব্য অবশ্যই নিন্দনীয়। আবার মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে সম্প্রতি কিছু রাজনীতিক যে সব মন্তব্য করেছেন, সেগুলিও সমান নিন্দনীয়। আমরা অনুব্রতের মন্তব্য সম্পর্কে খোঁজখবর করে জানতে পারি, পুলিশ ইতিমধ্যেই মামলা করেছে। ঠিক যেমন মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে করা মন্তব্যের প্রতিবাদেও মামলা হয়েছে। তাই আমরা কোনও ক্ষেত্রেই আলাদা ভাবে তদন্ত করছি না।”

অন্য দিকে, বোলপুরের আইসি এবং তাঁর পরিবারকে জড়িয়ে কুকথা বলা ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগে অনুব্রতের বিরুদ্ধে পুলিশ কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চেয়ে বৃহস্পতিবারই রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারকে চিঠি দিয়ে ‘অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট’ চেয়েছিল জাতীয় মহিলা কমিশন। বীরভূম জেলা পুলিশের পাঠানো রিপোর্ট নিয়ে জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্য অর্চনা মজুমদার আবার প্রশ্ন তোলেন, ওই পুলিশ আধিকারিক যে ফোন থেকে কথোপকথনটি রেকর্ড করেন, তা বাজেয়াপ্ত করা হলেও কেন অনুব্রতের ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়নি? এ বিষয়ে পুলিশের ব্যাখ্যা, কোন ফোন থেকে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা কথা বলেছিলেন, জানতে পারলেই তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। প্রশ্ন উঠছে, রাজ্য মহিলা কমিশন কি জাতীয় মহিলা কমিশনের মতো অনুব্রতের মন্তব্য নিয়ে পুলিশের থেকে রিপোর্ট তলব করবে? লীনার জবাব, “কমিশনের কাছে সে সুযোগ আছে। তবে এ নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”

মানবাধিকার কর্মীরা অবশ্য কমিশনের নীরবতায় বিস্মিত নন। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের তথাকথিত নিরপেক্ষ সংস্থাগুলি আসলে প্রচ্ছন্ন ভাবে শাসক দলের শাখা সংগঠনের কাজ করে। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর নেতা রঞ্জিত শূরের বক্তব্য, “কোনও ঘটনায় পুলিশ তদন্ত করলে মহিলা কমিশন তা করতে পারবে না, এমন কোনও নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের নেই। আসলে নিরপেক্ষতার মুখোশ যাতে খসে না পড়ে, তার জন্যই এই সব যুক্তি সাজিয়েছেন মহিলা কমিশনের প্রধান। রাজ্য হোক বা জাতীয়, কোনও মহিলা কমিশনই নিরপেক্ষ নয়। যে সব রাজ্যে বিজেপি বা এনডিএ ক্ষমতায় আছে, সেখানে আবার নারী নির্যাতনের ঘটনায় জাতীয় মহিলা কমিশনের ভূমিকা লজ্জাজনক। তারা শুধু সেই সব রাজ্যেই যায়, যেখানে বিরোধীদের সরকার আছে। তবে একই ঘটনায় রাজ্য ও জাতীয় মহিলা কমিশন একসঙ্গে তদন্ত করতে পারে না।”

অর্থনীতির অধ্যাপিকা ও নারী অধিকার রক্ষা কর্মী শাশ্বতী ঘোষের বক্তব্য, “অনুব্রত প্রসঙ্গে রাজ্য মহিলা কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আমি অন্তত বিস্মিত নই। আসলে শাসন ক্ষমতার বদল হলেও এই ধরনের সংস্থাগুলির অবস্থান বদলায় না। মনে রাখা দরকার, নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনাতেও তৎকালীন রাজ্য মহিলা কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নাতীত ছিল না। আবার দিল্লিতে জাতীয় মহিলা কুস্তিগিরদের অভিযোগ নিয়েও জাতীয় মহিলা কমিশনের ভূমিকা সবার মনে আছে।” অনুব্রতের কটূক্তি প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “এক জন পুরুষ আর এক জন পুরুষকে আক্রমণ করছে নারীদের অসম্মানিত করে। নারীদের এরা কত সুলভ হাতিয়ার বলে মনে করে, এটা তারই উদাহরণ।”

অনুব্রত প্রসঙ্গে রাজ্য মহিলা কমিশনের নীরবতায় সরব বিরোধীরাও। সিপিএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় মনে করেন, “রাজ্য মহিলা কমিশন নিরপেক্ষ থাকলে রাজ্যে মহিলাদের উপরে নির্যাতন এ ভাবে বাড়ত না। কমিশনের নিরপেক্ষতার মুখোশ অনেক আগেই খসে পড়েছে।” রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “রাজ্য মহিলা কমিশনের কাজ হল, জাতীয় মহিলা কমিশন কোথাও এলে তার আগে সেখানে পৌঁছে গোলমাল করা। অনুব্রত যা বলেছে, সেটাই তৃণমূলের কর্মসূচি। অনুব্রত তৃণমূলের মুখ, তৃণমূলের রোলমডেল। ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পুলিশেরও নেই। মহিলা কমিশন কী করবে?” তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের মন্তব্য, “মহিলা কমিশন একটি স্বশাসিত সংস্থা। তারা কী করবে, তা নিয়ে মন্তব্য করছি না। আমাদের দলের অবস্থান খুব স্পষ্ট। দলের নজরে আসার পরে ওই মন্তব্যের নিন্দা করা হয়েছিল। তাঁকে (অনুব্রত) ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল। তিনি তা করেছেন।”

তথ্য সহায়তা: দয়াল সেনগুপ্ত

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Anubrata Mondal TMC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy