ময়না তদন্তের আগেই পাঁচটি মৃতদেহকে শল্য-প্রশিক্ষণের জন্য নাক-কান-গলা বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। শীর্ষস্তরের কোনও অনুমতি ছাড়া ওই কাজ করার অভিযোগ উঠেছিল আর জি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও প্রাক্তন দুই বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনায় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ওই তিন জনের বিরুদ্ধে রাজ্যকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে আর জি করের নাক-কান-গলা বিভাগে সেমিনার ছিল। সেখানে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের জন্য মৃতদেহ প্রয়োজন ছিল। অভিযোগ, সেই সময় সন্দীপের নির্দেশে মর্গ থেকে পাঁচটি দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই বিভাগে। ময়না তদন্তের জন্য আসা দেহ কী ভাবে পাঠানো হল তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। প্রশ্ন ওঠে ময়নাতদন্তের আগেই হাতে কলমে শল্য শিক্ষার জন্য মৃতদেহগুলি কাটাছেড়া করার অনুমতি কী ভাবে কলেজ কর্তৃপক্ষ দিতে পারেন?
সূত্রের খবর, সেই সময়েই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। সম্প্রতি ৩৬ পাতার একটি নির্দেশনামা জারি করেছে কমিশন। তাতে বলা হয়েছে নাক-কান-গলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান চিকিৎসক ইন্দ্রনাথ কুন্ডু একটি সেমিনারের আয়োজন করেন। তার জন্য তিনি পাঁচটি মৃতদেহ চাইলে সন্দীপের নির্দেশে ফরেন্সিক মেডিসিনের তৎকালীন প্রধান চিকিৎসক প্রবীর চক্রবর্তী ময়না তদন্তে আসা পাঁচটি দেহ পাঠিয়ে দেন। এবং সেই দেহগুলির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে যন্ত্র ব্যবহার করে সাইনাস সার্জারির প্রশিক্ষণ হয়েছিল। যার ফলে তথ্য-প্রমাণ নষ্ট হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে কমিশন।
নির্দেশনামাতে এমনও বলা হয়েছে মৃতদেহ ব্যবহার সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্ট এবং হাই কোর্টের সমস্ত গাইডলাইনকে অগ্রাহ্য করে এই কাজ করা হয়েছে। তাতে মৃতদেহের মর্যাদা লঙ্ঘিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এই কাজের জন্য অ্যানাটমি এবং অর্গান অ্যান্ড টিস্যু আইনকেও অমান্য করা হয়েছে। পাশাপাশি তদন্ত চলাকালীন, ওই তিন ব্যক্তি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন বলেও জানানো হয়েছে। কমিশন নির্দেশনামাতে জানিয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ভুয়ো তথ্য দিয়ে তদন্তকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করেছিলেন ওই তিন জন। কমিশনের মতে, তদন্তকারীরা যাতে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারে তার জন্যই এমন বিভিন্নভাবে বাধা দেওয়া হয়েছিল।
কমিশন রাজ্যের মুখ্য সচিবকে নির্দেশ দিয়েছে ওই তিন জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেই রিপোর্ট তিন মাসের মধ্যে মানবাধিকার কমিশনকে জমা দিতে হবে। সন্দীপ এখন জেলে রয়েছে। আর জি কর থেকে অবসরের পরে প্রবীর এখন অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত। ইন্দ্রনাথ বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে রয়েছেন। একই সঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিবকেও কমিশন নির্দেশ দিয়েছে অবিলম্বে সব হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান, অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষদের উদ্দেশে সার্কুলার জারি করতে হবে। তাতে স্পষ্ট জানাতে হবে এ বার থেকে আর কোনও মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালে আয়েজিত কর্মশালা বা পঠন-পাঠনে মর্গ থেকে ময়নাতদন্তের আগে মৃতদেহ আনা যাবে না।
এ দিন ইন্দ্রনাথ কুণ্ডুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমার আবেদনে কোনও ত্রুটি ছিল না। দেহ দেওয়ার বিষয়ে নিয়মের বিচ্যুতি ঘটে থাকলে তার দায় আমার নয়।’’ প্রবীর চক্রবর্তীকে এ দিন একাধিক বার ফোন করা হলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি উত্তর দেননি মেসেজেরও।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)