Advertisement
E-Paper

দুই রেলে আমরা-ওরা, জলে হাবুডুবু যাত্রী

ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁইয়ের কিস্‌সা এ বার রেলে! একই রেলের অনেক শাখার মধ্যে দু’টি হল পূর্ব আর দক্ষিণ-পূর্ব রেল। হাওড়ায় এক চত্বরে তাদের অবস্থানও পাশাপাশি। এ বারের দুর্যোগে জল জমে দু’টি শাখাই বিষম বিপাকে পড়েছে। তারই মধ্যে জমা জলের সমস্যা মেটানোর ক্ষেত্রে এসে পড়ছে ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪১
চলছে প্লাবিত রেললাইন পরীক্ষার কাজ। বৃহস্পতিবার হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায়।— নিজস্ব চিত্র

চলছে প্লাবিত রেললাইন পরীক্ষার কাজ। বৃহস্পতিবার হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায়।— নিজস্ব চিত্র

ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁইয়ের কিস্‌সা এ বার রেলে!

একই রেলের অনেক শাখার মধ্যে দু’টি হল পূর্ব আর দক্ষিণ-পূর্ব রেল। হাওড়ায় এক চত্বরে তাদের অবস্থানও পাশাপাশি। এ বারের দুর্যোগে জল জমে দু’টি শাখাই বিষম বিপাকে পড়েছে। তারই মধ্যে জমা জলের সমস্যা মেটানোর ক্ষেত্রে এসে পড়ছে ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন!

ফি-বছর ভারী বর্ষণে জল জমে ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত হয় হাওড়ায়। এ বারের দুর্যোগের জেরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাবুডুবু খেয়েছে ওই বিশাল স্টেশন-চত্বর। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না-হওয়ায় আমযাত্রীর ভোগান্তি এ দিনও অব্যাহত ছিল। বর্ষা এলেই যে এ ভাবে জল-সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেল এবং হাওড়া পুরসভার যৌথ উদ্যোগ ছাড়া তার স্থায়ী সুরাহা সম্ভব নয় বলে প্রাক্তন রেলকর্তা ও বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন।

কিন্তু কলকাতায় বণিকসভার একটি আলোচনাসভায় পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার ঘনশ্যাম সিংহ এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা শুধু পূর্ব রেলের অংশে জল জমার বিষয়টি নিয়েই ভাবনাচিন্তা করছেন। ‘‘আমরা আমাদের এলাকায় জল জমা ঠেকাতে একটি উপদেষ্টা সংস্থাকে বরাত দিয়েছি। তারা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে পুজোর সময় রিপোর্ট দেবে। তার পরেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে,’’ বলেছেন ঘনশ্যাম।

কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার কথা যাদের, সেই দুই রেলের এক পক্ষের এই মনোভাবে রেলের প্রাক্তন ও বর্তমান অনেক কর্তাই হতবাক। পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারের কথা শুনে সব থেকে বিস্মিত দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, যে-জায়গায় জল জমেছে, সেখানে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব দুই রেলেরই লাইন আছে। তাই জল বার করতে গেলে এবং জল জমার সমস্যা স্থায়ী ভাবে মেটাতে গেলে এই দুই রেলের সমান সক্রিয়তা দরকার। সেই সঙ্গে দরকার হাওড়া পুরসভাকে। এই তিন পক্ষ একসঙ্গে বারবার না-বসলে, সমান সক্রিয়তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে না-পড়লে এই সমস্যার সমাধান হবে না।

এই অবস্থায় পূর্ব রেলের প্রধান কী ভাবে এমন কথা বলতে পারেন, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কর্মী-অফিসারেরা সেটা ভেবে পাচ্ছেন না। ওই রেলের কর্তাদের অনেকের অনুযোগ, এটা নিতান্ত স্বার্থপর চিন্তাভাবনা। শুধু নিজেদের এলাকাকে ঝঞ্ঝাটমুক্ত করার জন্য পূর্ব রেলের এই উদ্যোগে হাওড়ায় জল জমার সমস্যা আদৌ মিটবে কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরছে রেলের অন্দরেই। সাধারণ রেলকর্মীদের বক্তব্য, সংসারে ভাইয়ে-ভাইয়ে ঠোকাঠুকি থাকলেও বিপদের সময় কেউ সেটা মনে রাখে না। যাবতীয় মন কষাকষি ভুলে ভাইয়ের দুঃসময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাই। এ ক্ষেত্রে তো রেলের দুই ভাই-ই বিপন্ন। সেখানে এক ভাই এ-রকম একলষেঁড়ে মনোভাব দেখাচ্ছে কী ভাবে?

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মধ্যে সমন্বয় যে কোন তলানিতে পৌঁছেছে, জল জমার সমস্যাকে ঘিরে সেটা প্রকট হয়েছে। রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু এর আগে কলকাতায় এসে লোকাল ট্রেনের কামরায় কামরায় উঠে পরিষেবার ঘাটতির ব্যাপারে যাত্রীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছিলেন। তাঁর সংস্থার অন্দরেই যে ভাইয়ে-ভাইয়ে বিভাজনের খেলা চলছে, সেটার সুরাহা প্রভু কী ভাবে করেন, সেটাই দেখতে চান যাত্রিসাধারণ। বিপর্যয়ের মধ্যে আজ, শুক্রবারেই প্রভুর আসার কথা ছিল কলকাতায়। নৈহাটিতে জুবিলি সেতুর উদ্বোধন-সহ কয়েকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল তাঁর। অসুস্থতার কারণে সেই সফর শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়েছে। তাঁর জায়গায় আসছেন রেল প্রতিমন্ত্রী রাজেন্দ্র গোয়েল। ওই আমরা-ওরার বিষয়টিতে তিনি দৃষ্টি দেন কি না, রেলকর্তাদের নজর সে-দিকেই।

মন্ত্রী মুশকিল-আসান হতে পারবেন কি না, সেটা পরের ব্যাপার। আপাতত রেলের দু’ভাইয়ের ঠোকাঠুকিতে ভুগতে হচ্ছে যাত্রীদেরই। ৭২ ঘণ্টা আগে বৃষ্টি থেমে যাওয়া সত্ত্বেও হাওড়ায় তাঁদের ভোগান্তি শেষ হয়নি। হাওড়ার কারশেডে এখনও জল দাঁড়িয়ে থাকায় স্বাভাবিক হয়নি ট্রেন চলাচল। এ দিন সকালে হাওড়া-খড়্গপুর শাখায় ৩১টি লোকাল ট্রেন বাতিল করা হয়। চারটি দূরপাল্লার ট্রেন হাওড়ার বদলে ছেড়েছে সাঁতরাগাছি থেকে। একই কারণে ফিরতি পথেও দূরপাল্লার ছ’টি ট্রেনকে হাওড়ায় না-এনে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে সাঁতরাগাছিতে। শুক্রবার হাওড়া-খড়্গপুর শাখায় স্বাভাবিক ভাবে ট্রেন চালানো যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব রেল। মন্ত্রীর আগমনের খবর পেয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে উঠেপড়ে লেগেছেন রেলের সাধারণ কর্মী-অফিসারেরা।

রবি-সোমবারের বৃষ্টিতে বেহাল হয়ে পড়ে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের পরিষেবা। বিপর্যয়ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাওড়া-বর্ধমান শাখায় ট্রেন চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেলেও টিকিয়াপাড়া কারশেডে জল জমে থাকায় হাওড়া-খড়্গপুর শাখায় দু’দিন ধরে বিপর্যস্ত হয়েছে ট্রেন চলাচল।

ভারী বর্ষণে হাওড়া কারশেড এলাকায় জল জমার সমস্যা চলছে ২০ বছর ধরে। যে-এলাকায় জল জমে এবং এ বারেও জমেছে, সেই টিকিয়াপাড়া দিয়ে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব দুই জোনেরই লাইন গিয়েছে। বৃষ্টির জল জমলে দুই রেলেরই ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে যায়, গিয়েছেও। রেলকর্তাদের একাংশ বলছেন, বর্ষায় হাওড়ায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হলে কারশেডে জল জমা ঠেকাতে হবে। নইলে লাইন ডুববে। লাইন ডুবলে সিগন্যাল এবং পয়েন্ট ক্রসিংও ডুবে থাকবে। বিপর্যস্ত হবে ট্রেন চলাচল। ভুগবেন যাত্রিসাধারণ।

যাত্রী থেকে রেল ইঞ্জিনিয়ারদের একটি বিরাট অংশ মনে করেন, টিকিয়াপাড়া কারশেডে জল জমা ঠেকাতে গেলে দরকার সময়োপযোগী একটি বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা। যেটা পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব রেল এবং হাওড়া পুরসভার কর্তাদের একসঙ্গে বসে তৈরি করতে হবে। নইলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এ বার বিপর্যয়ের পরেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কর্তারা জানিয়েছিলেন, জল-সমস্যার স্থায়ী সমাধানে হাওড়া পুরসভা, পূর্ব রেলকে নিয়ে বৈঠকে বসে পরিকল্পনা তৈরি করবেন তাঁরা।

স্থায়ী সুরাহা দূরের কথা, এ বারের জল-সমস্যা মিটতে না-মিটতেই পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার যে-ভাবে নিজেদের অংশটুকুর ঝামেলা মেটানোর কথা বলছেন, তাতে সামগ্রিক পরিস্থিতির মোকাবিলা কবে কী ভাবে হবে, সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

Rail tracks Water logged
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy