Advertisement
E-Paper

রেলের মাল চুরি, দু’বছর জেল তৃণমূল বিধায়কের

চুরির দায়ে জেল হল তৃণমূল বিধায়কের। বিশ বছর আগে দায়ের হওয়া রেলের যন্ত্রাংশ চুরির এক মামলায় মঙ্গলবার রানিগঞ্জের বিধায়ক সোহরাব আলিকে দু’বছর কারাদণ্ড দিল আসানসোল আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৮

চুরির দায়ে জেল হল তৃণমূল বিধায়কের।

বিশ বছর আগে দায়ের হওয়া রেলের যন্ত্রাংশ চুরির এক মামলায় মঙ্গলবার রানিগঞ্জের বিধায়ক সোহরাব আলিকে দু’বছর কারাদণ্ড দিল আসানসোল আদালত। যদিও সোহরাব উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানানোয় এ দিনই তাঁর জামিন হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ এখনই তাঁকে জেলে যেতে হচ্ছে না। আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে এক মাসের মধ্যে বর্ধমান জেলা আদালত বা দু’মাসের মধ্যে হাইকোর্টে আবেদন করতে পারেন সোহরাব। উচ্চ আদালত যদি স্থগিতাদেশ দেয় তবে আপাতত জেল খাটা এড়াতে পারবেন তিনি। কিন্তু বিধায়ক পদে তিনি আর থাকতে পারবেন কি না, সংশয় রয়েছে। কেননা ২০১৩ সালেই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, কোনও সাংসদ বা বিধায়কের দু’বছর বা বেশি সময় কারাদণ্ড হলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে পদ খোয়াবেন।

বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, ‘‘টিভিতে খবরটা শুনলাম। আদালতের রায় না-দেখে কোনও মন্তব্য করব না।’’ তবে, শীর্ষ আদালতের সেই রায়ের জেরে গোটা ভারতে ইতিমধ্যেই একাধিক জনপ্রতিনিধি পদ খুইয়েছেন। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন আরজেডি নেতা লালু প্রসাদ যাদব। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়েছিল জয়ললিতাকেও। যদিও পরে উচ্চ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে তিনি ফের ক্ষমতায়।


অন্য মামলায় ২০১২ সাল থেকে সোহরাবের এই ছবি সাঁটা দুর্গাপুর আরপিএফ পোস্টে।

উচ্চ আদালত সোহরাবের ভাগ্যে কী এনে দেবে, সেটা পরের কথা। আপাতত দলের বিড়ম্বনা বাড়ালেন তিনি। এমনিতেই সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে জেরবার তৃণমূল। এক মন্ত্রী দীর্ঘদিন জেলে। জেলবন্দি এক সাংসদ সাসপেন্ড। আর এক জন জামিন পেয়েই দল এবং সাংসদ পদ— দুইই ছেড়েছেন। কিন্তু এঁদের সবার পক্ষে বলার কথা এটাই যে, তাঁরা অভিযুক্ত। সাজাপ্রাপ্ত নন। সোহরাবের শাস্তি ঘোষণা হয়ে গিয়েছে।

এহেন বিড়ম্বনার পরেও তৃণমূল অবশ্য সোহরাবের পাশে দাঁড়ানোরই ইঙ্গিত দিয়েছে। চুরির ঘটনার সময় সোহরাব তাঁদের দলে ছিলেন না, এই তথ্যকেই এখন ঢাল করতে চাইছেন তৃণমূল নেতারা। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘আদালত ঠিক কী নির্দেশ দিয়েছে, না জেনে কিছু বলতে পারব না। তবে ওই ঘটনার সময়ে সোহরাব কোন দলে ছিলেন, খোঁজ নিন! তখন তো বিরোধীদের পাশাপাশি শরিক দলগুলিকেও চাপে রাখার জন্য সিপিএম নানা অভিযোগে ফাঁসাত!’’

কিন্তু ঘটনা হল, চুরির মামলা দায়ের হওয়ার সময় সোহরাব কোনও দলেই ছিলেন না। তার আগের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসেবে জিতে প্রথম কাউন্সিলর হন। ১৯৯৯ সালে দাঁড়ান আরজেডি-র হয়ে। ২০০১-র বিধানসভা ভোটে হিরাপুর কেন্দ্রে (এখন লুপ্ত) লালু প্রসাদের দলেরই প্রার্থী ছিলেন। লালু তাঁর হয়ে প্রচারও করে যান। তবে সোহরাব জিততে পারেননি। ২০০৪ সালে ফের নির্দল হিসেবে আসানসোলের কাউন্সিলর। শেষে, ২০০৯ সালে পুরভোটে দাঁড়ান আরএসপি প্রার্থী হয়ে। কিন্তু সে দলে উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছেন না দাবি করে ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে সোহরাব তৃণমূলে যোগ দেন। এবং প্রায় সতেরোশো ভোটে হারান সিপিএম প্রার্থীকে।

আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মনোজ ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, ‘‘সোহরাব আগে আমাদের দলে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে এলাকায় নানা অভিযোগ এসেছিল এবং দলের পক্ষে বিড়ম্বনার কারণ হচ্ছিল বলেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে দেওয়া হয়।’’ যদিও আরএসপি সোহরাবকে বহিষ্কার করেছিল এমন কোনও তথ্য নেই।

কোন মামলায় সোহরাবকে দোষী সাব্যস্ত করল আদালত?

রেল পুলিশ সূত্রের খবর, ১৯৯৫ সালের ২৭ অগস্ট আরপিএফের আসানসোল পশ্চিম পোস্ট সোহরাব আলি-সহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে রেলের যন্ত্রাংশ চুরির অভিযোগ দায়ের করে। ২৫ হাজার টাকা মূল্যের সেই সব যন্ত্রাংশ অভিযুক্তদের হেফাজত থেকে উদ্ধারও করা হয়েছিল বলে জানায় আরপিএফ। অভিযুক্তেরা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।

মামলা চলাকালীন, ১৯৯৮ সালে এক অভিযুক্তের মৃত্যু হয়েছিল। এ দিন সোহরাব-সহ বাকি চার জনকেই দোষী সাব্যস্ত করেন আসানসোলের সপ্তম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অনিন্দ্য সেন। তাঁদের দু’বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দু’মাস জেলের নির্দেশ দেওয়া হয়। রায় শুনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সোহরাব বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আমি নির্দোষ। মাফ করে দিন।’’ অভিযুক্তদের তরফে জানানো হয়, তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন। যে হেতু সম্পত্তি হাতানোর মামলায় নিম্ন আদালতে তিন বছরের কম সময়ের জন্য জেল হয়েছে, তাই বিচারক জরিমানার দ্বিগুণ টাকা বন্ড হিসেবে জমা রাখার শর্তে জামিন মঞ্জুর করেন।

আদালতে ভিড় জমিয়েছিলেন তৃণমূলের বহু কর্মী-সমর্থক। সোহরাব জামিন পেয়ে আদালত থেকে বেরনোর পরে স্লোগান দিতে থাকেন তাঁরা। সোহরাব বলেন, ‘‘আদালতের রায় নিয়ে কিছু বলব না। তবে আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চক্রান্ত করে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল।’’

সোহরাবের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ অবশ্য এই প্রথম নয়। তাঁর নামে দুর্গাপুরেও রেলের যন্ত্রাংশ চুরির একটি মামলা রয়েছে বলে রেল পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। ১৯৯৩ সালে সেই অভিযোগ দায়ের করে আরপিএফ। ২০১২ সালের মার্চে ওই মামলায় সোহরাবের নামে পরোয়ানা জারি করে আদালত। নিয়মমাফিক সোহরাবের ছবি-সহ সেই পরোয়ানা আরপিএফ পোস্টে নির্দিষ্ট বোর্ডে সেঁটেও দেওয়া হয়। এখনও সেই ছবি বোর্ডে সাঁটা আছে।

বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হওয়ার পরেও লোহা চুরির অভিযোগের কথা তুলে রানিগঞ্জের নানা জায়গায় সোহরাবের নামে পোস্টার পড়েছিল। আসানসোলের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী বলেন, ‘‘ভোটের আগে আমরা যে ঠিক বলেছিলাম, আজ তা প্রমাণিত হল।’’ দলের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘এর আগে রেল পুলিশ ওই এলাকায় অন্য অপরাধীদের সঙ্গে ওঁরও (‌সোহরাব) ছবি দিয়ে প্রচার করেছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এঁদেরই সম্পদ মনে করেছেন। এখন আদালতের নির্দেশে যা হল, সেটা পশ্চিমবঙ্গেরই লজ্জা! তবে যে জমানায় মদন মিত্র দিনের পর দিন জেলে কাটিয়েও মন্ত্রী থেকে যেতে পারেন, সেখানে বিধায়কের যে কিছু হবে না, এতে আর আশ্চর্য কী!’’

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে কি বিধায়ক পদে থেকে যেতে পারবেন সোহরাব? বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার, সিপিএমের হাসিম আব্দুল হালিমের বক্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হয়ে দু’বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ড হওয়ায় ওই বিধায়কের বিধানসভার সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাওয়া উচিত।’’ হালিম জানান, রায়ের প্রতিলিপি স্পিকারের কাছে আসার পই তাঁর সংশ্লিষ্ট বিধায়কের সদস্যপদ বাতিল করার নিয়ম। সোহরাবের বিধায়ক-পদ খারিজ হয়ে যাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ও।

দু’মাস আগেই মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সচিব পদে নির্বাচিত করা হয়েছে সোহরাবকে। এ বার তাঁর সম্পর্কে ‘পর্যালোচনা’ করা হবে বলে জানিয়েছেন হাওড়ার তৃণমূল সাংসদ তথা ক্লাব সভাপতি সুলতান আহমেদ।

— নিজস্ব চিত্র।

sohrab ali mohammedan sporting club sohrab ali jail sohrab ali jail term railway properties raniganj mla two years jail abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy