আদালতের নির্দেশে ধর্ষণে অভিযুক্ত এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হল অভিযোগকারিণী কিশোরীর। বৃহস্পতিবার সিউড়ি কোর্ট লকআপে ওই বিয়ের সাক্ষী থাকলেন পুলিশকর্মী ও কৌঁসুলিরা। দু’মাস জেল হাজতে কাটিয়ে এ দিন অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পায় অভিযুক্ত।
পুলিশ সূত্রে খবর, গত ২২ মার্চ বীরভূমের মুরারই থানা এলাকায় মেলা দেখতে মামাবাড়ি এসেছিল ওই কিশোরী। তাকে নির্জন স্থানে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল পড়শি যুবকের বিরুদ্ধে। পুলিশ ধৃতের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ (ধর্ষণ) ধারা, এবং ‘প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সচুয়াল অফেনশেস অ্যাক্ট ২০১২’ (পকসো) প্রয়োগ করেছিল। নির্যাতিতা গোপন জবানবন্দিও দিয়েছিল। এর পরেও তাদের বিয়ে দেওয়া হল কেন?
এ দিন বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে পাত্র এবং পাত্রী, দু’জনেরই বাবা দাবি করেন, ‘‘ওদের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সেটা অতীত।’’ অভিযুক্তের আইনজীবী বলেন, ‘‘দুই পরিবারই বিয়ের জন্য আবেদন করেছিল। বিশেষ আদালতের বিচারক মহানন্দ দাস এ দিন তা মঞ্জুর করেন।’’
কিন্তু ধর্ষণে অভিযুক্তের সঙ্গে নির্যাতিতার বিয়ের নির্দেশ দেওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার বলেন, ‘‘ধর্ষণ ক্ষমার অযোগ্য। অথচ শাস্তি দেওয়ার বদলে অভিযুক্তকে এক হিসাবে পুরস্কৃতই করা হচ্ছে!’’ ওই নাবালিকা কতটা স্বেচ্ছায় এই বিয়েতে সম্মত হয়েছে, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি।
ধর্ষণে অভিযুক্তের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পরিবার সমাজে মুখরক্ষা করতে চাইলেও, মেয়েটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা থাকে, বলছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘অনেক সময় দেখা যায়, এ রকম ক্ষেত্রে দু’দিন বাদে ছেলেটি তালাক দিয়ে দেয়। এতে সে অপরাধের শাস্তিও পেল না, আবার বিয়ে থেকেও মুক্ত হল।’’
সিউড়ি আদালমতের এই মামলায় পুলিশ এখনও চার্জশিটও দেয়নি। মামলার ভবিষ্যত কী? সরকারি আইনজীবীর স্বীকারোক্তি, ‘‘বিয়ে যখন হয়ে গিয়েছে, তখন তার পরিণতি সুদূরপ্রসারী হবে না।’’
সুপ্রিম কোর্টের অবসারপ্রাপ্ত বিচারপতি তথা রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য এই রায়ে আপত্তির কিছু দেখছেন না। তিনি বলেন, ‘‘দু’পক্ষই মেনে নিলে আদালত কী করবে!’’ একই ব্যাখ্যা সিউড়ি আদালতের সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়েরও। তিনি বলেন, ‘‘সামজিক দিক বিবেচনা করেই বিচারক এই রায় দিয়েছেন।’’
কিন্তু বিতর্ক এতেই শেষ নয়। কিশোরীর বয়স মাত্র ১৬। আদালত কী করে নাবালিকার বিয়ের নির্দেশ দিল? মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর আওতায় বিয়ে হতেই পারে বলে আইনজ্ঞদের একাংশের মত। অভিযুক্তের আইনজীবী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘সিউড়ির বিশেষ আদালতের নির্দেশে ম্যারেজ রেজিস্টারের সামনে মুসলিম পার্সোনাল ল’-র ২৫১ ধারা মেনে এই বিয়ে হয়েছে।’’ কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘হিন্দুই হোক বা মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে তার বিয়ে আইনসিদ্ধ হওয়ার কথা নয়। কীসের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই রায় দিয়েছে, নির্দেশের কপি না দেখে বলা সম্ভব নয়।’’ মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দাদেবীও বলেন, ‘‘মুসলিম আইনে ১৫ বছরে মেয়েদের সাবালিকা বলে ধরা হয়। সেই নিরিখে হয়তো কোর্ট বিয়ের নির্দেশ দিয়েছে। তা-ও বলব, এই রায় দুর্ভাগ্যজনক।’’
অতীতে বহু মামলায় দেখা গিয়েছে, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর যুক্তি উচ্চ আদালতে ধোপে টেকেনি। গত এপ্রিল মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি এস তামিলভানান এবং ভি এস রবির ডিভিশন বেঞ্চ ১৬ বছরের এক আদালত স্পষ্ট বলেছিল, ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর দোহাই দিয়ে বয়ঃসন্ধিতে থাকা নাবালিকাকে বিয়ে দেওয়ার অধিকার দাবি করা যায় না। তার এক মাস আগে ওই আদালতেই বিচারপতি সি টি সেলভানের সিঙ্গল বেঞ্চও অপর একটি আবেদনকে খারিজ করে বলেছিল, ‘‘পিসিএমএ-র সঙ্গে মুসলিম পার্সোনাল ল’র কোনও বিরোধ নেই।’’ ২০১২ সালে একটি মামলায় একই বক্তব্য ছিল কর্নাটক হাইকোর্টেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy