Advertisement
০৯ মে ২০২৪

ফাইল গোপন রেখে দিলেই আজগুবি কাহিনি জন্ম নেয়

তিন জন মানুষের কথা দিয়ে কাহিনি শুরু করি। ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে— এই মর্মান্তিক খবর তাঁর মেজদাদা পেলেন ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ও ‘হিন্দু’ খবরের কাগজ মারফত।

নথিতে নজর কৃষ্ণা বসুর। — নিজস্ব চিত্র।

নথিতে নজর কৃষ্ণা বসুর। — নিজস্ব চিত্র।

কৃষ্ণা বসু
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:০৮
Share: Save:

তিন জন মানুষের কথা দিয়ে কাহিনি শুরু করি।

১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে— এই মর্মান্তিক খবর তাঁর মেজদাদা পেলেন ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ও ‘হিন্দু’ খবরের কাগজ মারফত। শরৎচন্দ্র বসু তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন— ‘মা, আর কত বলিদান তোমাকে দিতে হবে। আর কত আঘাত তুমি দেবে! এই শেষ আঘাত বড়ই কঠোর।’ তিনি তখন কুনুরে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।

আমার স্বামী ডাক্তার শিশিরকুমার বসু পঞ্জাবে বন্দি অবস্থায় এই খবর পেয়ে বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় মা বিভাবতীকে লিখলেন— ‘আমরা সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে এই পরীক্ষার মুখোমুখি হব।’

আমাদের কাকিমা এমিলিয়ে ভিয়েনাতে তাঁর রান্নাঘরের রেডিওতে অকস্মাৎ খবর শুনলেন, ‘ইন্ডিয়ান কুইসলিং সুভাষ বোসের বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে।’ শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন প্রথমে। তার পরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আইরিশ বান্ধবী মিসেস উডস সান্ত্বনা দিয়ে লিখলেন, ‘হয়তো এ খবর সত্য নয়।’

তিনি চিঠির জবাবে লিখলেন— ‘তা হলে আমার চাইতে বেশি সুখী কেউ হবে না। কিন্তু আমার মনে হয় উনি আর নেই। আমার জীবনে আমার শিশুকন্যাই একমাত্র সম্বল।’

এই যে তিন জন শোকাভিভূত ব্যক্তির কথা লিখলাম— এঁরা কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ভাবতে শুরু করলেন, তাই তো, এ ঘটনা সত্য না-ও হতে পারে। তিন জনই আশায় বুক বেঁধে উঠে দাঁড়ালেন।

মানুষ আশা নিয়েই বাঁচে। নেতাজিকে ঘিরে সেই একই মানসিকতা সারা দেশের মানুষের। এতকাল ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়েছেন, এ বারও নিশ্চয় তা-ই। দেশের মানুষ তাঁকে ফিরে পেতে আগ্রহী আর ব্রিটিশ সরকারও জানতে উৎসুক, কী ঘটেছিল। তাদের ক্ষেত্রে ভীতি, আবার ফিরে এসে গণ্ডগোল করবে নাকি। তারা জানতে চায়— ‘পারমানেন্টলি ডেড’ কি না।

শুক্রবার রাজ্য যে সব ফাইল বার করল, তাতে নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যাবে কি না, তা খুব ধীর-স্থির ভাবে ফাইল পড়ে দেখতে হবে। হাজার হাজার পাতার ফাইলে শুধু চোখ বুলিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। শুনেছি বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রণজিৎ গুহর একটি বই আছে। কী ভাবে স্পর্শকাতর বিষয়ের ফাইল পড়তে হয়, তার বিশেষ পদ্ধতি বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। বিভিন্ন এজেন্ট যখন কোনও ঘটনা রিপোর্ট করেন, তা ক্রস চেক করতে হয়। কখনও কখনও ভুল পথে চালিত করার জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে খবর রিপোর্ট হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে বিপ্লবীদের মধ্যে সরকার পক্ষের লোকও ঢুকিয়ে দেওয়া হতো।

রাজ্য সরকার যে সব ফাইল প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে, তা অত্যন্ত সঠিক। আশা করব কেন্দ্রও তাদের পথ অনুসরণ করবে। কারণ মনে হয়, দিল্লির ফাইলগুলি আরও গুরুত্বপূর্ণ। ফাইল গোপন করার ফল হয় অনেক গুজব আর অনেক আজগুবি কাহিনি। তার চাইতে যা বাস্তব, যা সত্য, তা মেনে নেওয়া ভাল।

এ দিনের ফাইল প্রকাশের পর স্বাভাবিক ভাবে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। উত্তেজনার মুহূর্তে এ সব ফাইল আলোচনা করা যায় না। যে বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে তা হল স্বাধীনতার পরেও কেন আমাদের পরিবারের উপর নজরদারি চালানো হচ্ছিল।

এ দিনের প্রকাশিত ফাইলেও দেখছি, ১৯৫৩ সালের জুনে কাকিমা এমিলিয়েকে লেখা শিশিরকুমারের চিঠি খুলে পড়া হচ্ছে। পড়ছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর— কপি ও রিপোর্ট যাচ্ছে দিল্লি ও কলকাতার উচ্চতম আধিকারিকদের কাছে। তাঁদের নামও দেওয়া আছে। ৬২ নম্বর ফাইল। ১৯৫৩ সাল অর্থাৎ ১৯৪৯-এর পরও ফাইল দেখছি। এই অন্যায় কাজ কেন চলছিল, জানা প্রয়োজন।

১৯৪৫ সালের পরের অনেক ফাইলে নেতাজিকে খোঁজা হচ্ছে— হয়তো এখানে, হয়তো সেখানে— সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সবই স্পেকুলেশনের স্তরে।

বিমান দুর্ঘটনা অনেকে বিশ্বাস করতে চান না। যদিও নেতাজি কন্যা অনিতা, শিশিরকুমার বসু, আজাদ হিন্দ ফৌজের বিশ্বস্ত অফিসারবৃন্দ লক্ষ্মী সহগল, প্রেম সহগল, গুরুবক্স ধীলোঁ এবং তাঁর জাপানি কমরেড-ইন-আর্মস জেনারেল ফুজিয়ারা কাটাকুরা, ইসোভা— সকলেই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। দুর্ঘটনার পরে জীবিত যাঁরা ছিলেন ও হাসপাতালের কর্মীদের সাক্ষ্য সেই রকম বলে।

কোনও দুর্ঘটনাই ঘটেনি, এমন খবর কাগজে পড়ে কো-পাইলটের ছেলে, যাঁর বাবা গুরুতর আহত হয়েও সত্তর দশকেও বেঁচে ছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন, তিনি বাবার কাছে যা শুনেছিলেন, তা কি সত্য নয়?

নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যায় কি না— তা দেখে তবেই এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Krishna Basu Netaji files Kolkata abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE