E-Paper

তিস্তাপারের বৃত্তান্ত শুনতে ৩০০ কিমি হাঁটলেন ভূ-পর্যটক

গুরুদংমার, চো লামু, পওহুনরি ও জেমু হিমবাহপুষ্ট তিস্তা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৫ ০৯:৫৩
লাচেন চু ও লাচুং চু নদীর মিলনস্থলে সম্রাট মৌলিক।

লাচেন চু ও লাচুং চু নদীর মিলনস্থলে সম্রাট মৌলিক। ছবি: সংগৃহীত।

লাদাখ থেকে কন্যাকুমারীর পথে একশোরও বেশি নদীকে ছুঁয়ে এসেছেন তিনি। গঙ্গা অববাহিকা ধরে ৩০০০ কিলোমিটার সাইকেলে অভিযান করেছেন। দেখে এসেছেন রাশিয়ার ভল্গা, উজ়বেকিস্তানের আমুদরিয়া নদীর অববাহিকাও। এ বার উত্তরবঙ্গে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত জানতে ও তার সমস্যা বুঝতে সিকিমের চুংথাং থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ হাঁটলেন ভূ-পর্যটক ও নদীপ্রেমী সম্রাট মৌলিক। নদী বাঁচানোর বার্তা নিয়ে ২৪ এপ্রিল সিকিমের চুংথাং থেকে শুরু করে ১৮ দিনে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত তিস্তার পাশে পাশে হাঁটলেন তিনি। শুধু নদীকে চেনাই নয়, তার আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যেও নদী বাঁচানো এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে এসেছেন তিনি।

সিকিমের লাচুং চু ও লাচেন চু নদীর মিলনস্থল থেকে শুরু তিস্তা নদীর। গুরুদংমার, চো লামু, পওহুনরি ও জেমু হিমবাহপুষ্ট তিস্তা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে তিস্তা ও তার পার্শ্ববর্তী জনপদগুলির ভবিষ্যৎ আজ ঘোর সঙ্কটে। উদ্বিগ্ন সম্রাট জানাচ্ছেন, ২০২৩ সালে তিস্তার ভয়াবহ বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে যাওয়া বহু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। দেখেছেন, আজও কী ভাবে ভাঙা বাড়ি নিয়ে জীবন সংগ্রাম করে চলেছেন তাঁরা। আজও তাঁরা সেই আতঙ্ক থেকে বেরোতে পারেননি। সম্রাট বলছেন, ‘‘স্থানীয়েরা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে সিকিমের সাউথ লোনাক হ্রদের উপরে মেঘভাঙা বৃষ্টির ফলে সেই জল উপচে লাচুং চু নদী দিয়ে নেমে আসে। তার পরে তিস্তার বাঁধ ভেঙে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তবে এই ঘটনা এক দিনের নয়। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরেই এই বিপর্যয় ঘটেছিল। তার জেরে তিস্তার নদীখাত অনেকটাই উঁচু হয়ে গিয়েছে। অনেক জায়গায় এর ফলে পাহাড়ি নদীখাতে জল নেই, ফলে স্থানীয়েরা নদীকে পুজো করতে পারছেন না। নদীর ডান তীরের ঘরবাড়ি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’’ এমনকি, তিস্তা বাজারের কাছে ২৯ মাইলের বাসিন্দাদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে হয়তো তাঁদের পরিবেশগত উদ্বাস্তু হয়ে যেতে হবে।

এখানেই শেষ নয়। সম্রাট জানিয়েছেন, সমতলে এসে আবার রূপ বদলেছে পাহাড়ি তিস্তা। সেখানে নদীখাতের উপরেই চলছে দেদার কৃষিকাজ। আর তাতে কীটনাশক প্রয়োগের প্রভাব সরাসরি পড়ছে নদী এবং তার মৎস্যকুলের উপরে। ‘‘নদীখাতের চাষে কীটনাশকের প্রয়োগে নদীর বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হতে বসেছে। অথচ ওই কৃষিজীবী মানুষেরা এ কথা জানেনই না। সেখানে পানীয় জলের সমস্যাও রয়েছে।’’— বলছেন সম্রাট। এমনকি, সমতলে তিস্তার বুকে ব্যাপক হারে জমছে প্লাস্টিক, আবর্জনা। ভয়ঙ্কর ভাবে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে উত্তরবঙ্গের এই নদী। তিস্তা বয়ে গিয়েছে যে দুই রাজ্যের উপর দিয়ে, সেই সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও বিস্তর ফারাক রয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন সম্রাট, যার মাসুল দিচ্ছে তিস্তা।

তাই কলকাতার বাঘা যতীন এলাকার বাসিন্দা সম্রাট শুধু তিস্তাপারের বৃত্তান্ত শোনাই নয়, স্থানীয় স্কুলপড়ুয়াদের সচেতন করার পথেও হেঁটেছেন। ৩০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে গিয়ে একাধিক স্কুলের পড়ুয়াদের নদী নিয়ে রীতিমতো ক্লাস নিয়েছেন তিনি। ‘‘বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন কী, তা ছোটদের বুঝিয়েছি। নদীর পাশে উন্নয়ন হোক, কিন্তু তা যেন নদীর জলের বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের জীবন ধ্বংস করে না হয়, সেই ভাবনাটাই ওদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি।’’ —কলকাতায় ফিরে বললেন ভূ-পর্যটক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Teesta River

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy