Advertisement
E-Paper

শাসক মদতেই ত্রাসের রাজত্ব

দিন পনেরো আগের ঘটনা। সন্ধ্যা নামলেই বাড়ির সামনের রাস্তার আলো কেন নিভে যায়, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন এক প্রৌঢ় দীপক দাস। মাঝরাতে তাঁকে বাড়ি থেকে বার করে পেটানো হয়। মারের চোটে উপড়ে আসে দাঁত। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে মার খান সন্টু দাস নামে এক তরুণও। বছর খানেক আগে সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরছিলেন এক জমি-বাড়ির ব্যবসায়ী। আচমকাই তাঁকে ঘিরে ধরে মারধর করে সশস্ত্র এক দল যুবক।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫৬
শ্যামল কর্মকার

শ্যামল কর্মকার

দিন পনেরো আগের ঘটনা। সন্ধ্যা নামলেই বাড়ির সামনের রাস্তার আলো কেন নিভে যায়, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন এক প্রৌঢ় দীপক দাস। মাঝরাতে তাঁকে বাড়ি থেকে বার করে পেটানো হয়। মারের চোটে উপড়ে আসে দাঁত। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে মার খান সন্টু দাস নামে এক তরুণও।

বছর খানেক আগে সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরছিলেন এক জমি-বাড়ির ব্যবসায়ী। আচমকাই তাঁকে ঘিরে ধরে মারধর করে সশস্ত্র এক দল যুবক।

দু’টি ঘটনাই বামনগাছির। এবং দু’টি ক্ষেত্রেই মূল অভিযুক্তের নাম শ্যামল কর্মকার। বামনগাছির কলেজ পড়ুয়া সৌরভ চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যাওয়া ও তার পরে তার টুকরো টুকরো হওয়া দেহ মেলার ঘটনারও মূল অভিযুক্ত সে। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় কার্যত ত্রাস উঠেছিল শ্যামল ও তার দলবল। এলাকাবাসীর অভিযোগ, চোলাই মদের ঠেক চালানো, জমি-বাড়ির কারবার নিয়ন্ত্রণ কিংবা তোলাবাজি যে কোনও অপরাধেই সে ছিল পাণ্ডা। স্থানীয়রা বলছেন, শ্যামলের দলবলের উৎপাতে এলাকার মহিলারা সন্ধ্যার পরে সচরাচর রাস্তায় বেরোনোর সাহস করতেন না। আর এই যাবতীয় কুকর্মে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদতকেই দায়ী করেছেন বাসিন্দারা। বিজেপি নেতা রাহুল সিংহও এ দিন অভিযোগ করেন, অভিযুক্তদের পিছনে তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের মদত রয়েছে।

অপরাধীদের রাজনৈতিক মদত অবশ্য নতুন নয়। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এক সময় বাম নেতাদের ছত্রচ্ছায়াতেই ছিল এরা। পালাবদলের পর তারা নতুন শাসক দলে নাম লেখায়। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে একের পর এক ঘটনায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। বামনগাছিও তার ব্যতিক্রম নয়।

রবিবার বামনগাছি-কুলবেড়িয়ার বাসিন্দারা বলেন, চোলাইয়ের ঠেক কিংবা জমি-বাড়ির কারবার বাম আমলেও ছিল। সে সময় এলাকায় প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন বাবুলাল দত্ত। পঞ্চায়েত ভোটে বাবুলাল নির্দল হিসেবে দাঁড়াতেন। কিন্তু এলাকার সিপিএম নেতাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বাম সমর্থিত নির্দল হিসেবেও ভোটে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, সে সময় বাবুলালের শিবিরেই আশ্রয় নিয়েছিল শ্যামল ও তার শাগরেদরা। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও বলেন, “শ্যামলের উত্থান সিপিএম নেতা বাবুলাল দত্তের হাত ধরে। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মিছিলেও দেখা গিয়েছে তাকে।” শ্যামলের সঙ্গে সিপিএমের ঘনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে অবশ্য কিছু বলতে চাননি জেলার সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দী। তিনি বলেন, “বিষয়টি আমি ঠিক জানি না।” সিপিএমের একাংশ অবশ্য বলছেন, বাম জমানায় ওই এলাকায় সবাই বাবুলালের ঘনিষ্ঠ হতে চাইতেন। এমনকী, বর্তমানে ছোট জাগুলিয়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য তুষার মজুমদার ওরফে বিশুও ছিলেন বাবুলালের অনুগামী। তবে সিপিএম নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তুষারবাবু। বাবুলাল অবশ্য এ দিন বাড়িতে ছিলেন না। তবে তাঁর পরিবারের বক্তব্য, বাবুলাল কোনও দিন অন্যায়-অপরাধকে প্রশ্রয় দেননি। সে জন্যই অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি।

এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ২০০৮ সালে নির্দল হিসেবে পঞ্চায়েত ভোটে জিতেছিলেন তুষার। তার পর থেকে বাবুলালের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। তুষারের সঙ্গে সঙ্গে সরে যায় শ্যামলও। রাজ্যে পালাবদলের পর তুষার তৃণমূলে যোগ দেন। সিপিএম ক্ষমতা হারানোর পর বাবুলালও রাজনীতি থেকে সরে যান। বছর দুয়েক আগে বাবুলালের বাড়িতে হামলা চালায় এক দল যুবক, যারা শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলেই অভিযোগ। ছোড়া হয় বোমা, গুলি। হামলাকারীদের দলে শ্যামলও ছিল বলে অভিযোগ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রথমে কাঠের মিস্ত্রির কাজ করত শ্যামল। তার পর রেল বস্তি এলাকায় ছোটখাটো অপরাধ ও চোলাই বিক্রির কাজে নামে সে। অভিযোগ, ছোটখাটো চুরি-মারধরের ঘটনায় হাত পাকানোর পরে সে এলাকার সমাজবিরোধী কালুর দলে নাম লেখায়। কালুর ডান হাত ছিল আর এক ভাড়াটে খুনি সমরেশ ব্রহ্ম। পুলিশ সূত্রের খবর, কালুকে খুন করে এক সময় দলের পাণ্ডা হয়ে ওঠে সমরেশ। এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, সমরেশের সঙ্গে একাধিক খুনের ঘটনায় সঙ্গ দেয় শ্যামল। তার পরে ২০১২ সালে সমরেশকে খুন করে দলের পাণ্ডা হয় শ্যামল। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা জানান, সৌরভের মতো সমরেশের দেহও ঠিক এ ভাবে টুকরো টুকরো করে ফেলে রাখা হয়েছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, ওই খুনের মামলায় জেলও খাটে শ্যামল। গত বছরের ৩১ অক্টোবর শেষ বারের মতো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে শ্যামল। পুলিশ জানিয়েছিল, ডাকাতির উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়ার সময় তাকে ধরে ফেলা হয়। কিছু দিন জেলে কাটিয়ে জামিন পেয়ে সে ফিরে আসে বামনগাছিতে রেললাইন পাড়ের নিজের আড্ডায়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাসখানেক আগে শ্যামলের আড্ডার পাশেই একটি মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। মাস তিনেক আগেও ওই ঠেকের সামনে এক যুবকের বস্তাবন্দি মৃতদেহ পাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, খুন করে ট্রেনের সামনে ফেলে দেওয়া বা রেল লাইনে রেখে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা এর আগে বহু বারই হয়েছে।

কোথায় থাকে শ্যামল?

পূর্ণিমা অধিকারী নামে স্থানীয় এক মহিলা জানান, বেশ কিছু দিন তাঁর পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকত শ্যামল। নিজেকে পরিচয় দিত জমি-বাড়ির কারবারি হিসেবে। “সব সময় কোমরে রিভলভার নিয়ে ঘুরত ও।”বলছেন পূর্ণিমাদেবী। আবার দিন পনেরো আগে স্বাতী পাল নামে এক মহিলার বাড়ির এক তলায় ঘর ভাড়া নিয়েছিল সে। শ্যামলের স্ত্রী স্বাতীদেবীকে জানিয়েছিল, শ্যামল কাঠের দোকানে কাজ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, আদতে তোলাবাজি ও জমি-বাড়ির কারবারে দখলদারিই ছিল শ্যামলের আয়ের উৎস। এ সবের সঙ্গে গ্রামে একের পর এক চোলাইয়ের ঠেক গজিয়ে ওঠার পিছনে তাঁকেই দুষেছেন বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, ওই চোলাই ঠেকের প্রতিবাদ করাতেই মরতে হয়েছে সৌরভকে।

সেই অভিযোগের সত্যতা এ দিন বামনগাছিতে ঘুরে-ফিরে নজরেও এসেছে। বামনগাছি রেল স্টেশন তিন নম্বর লাইন সংলগ্ন বাজারে গিয়ে দেখা গেল, দোকানগুলির শেষ প্রান্তে একটি চোলাইয়ের ঠেক। পাশে ছড়িয়ে রয়েছে চোলাইয়ের অজস্র খালি পাউচ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সন্ধ্যা গড়াতেই বাজারের শেষে প্রকাশ্যে চোলাইয়ের আসর বসতো। সঙ্গে চলত বাজারে আসা মহিলাদের উদ্দেশে কটূক্তি। এলাকার এক বৃদ্ধের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে দুষ্কৃতীদের হাত ধরে গজিয়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি মদের বেআইনি দোকানও। “সন্ধ্যার পরে প্রকাশ্য রাস্তায় মদ খাওয়া বা বিক্রি করা এখানে পরিচিত ছবি।”মন্তব্য ওই বৃদ্ধের।

তবে এ সব ছাড়িয়েও উঠে এসেছে ওই এলাকায় জমি-বাড়ির কারবারের রমরমা। বারাসতের অদূরে এই জনপদের জমির দাম ক্রমশ বাড়ছে। তা ঘিরে গজিয়ে উঠেছে দালালির ব্যবসা। বছর কয়েক আগেও যে যুবকেরা সাইকেলে চেপে ঘুরতেন, এখন তাঁরা পাকা দোতলা বাড়ি ও মোটরবাইকের মালিক। এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেই এলাকা দখলে রাখা প্রয়োজন। শাসক দলের নেতারা তাই শ্যামলদের মতো সমাজবিরোধীদের হাতিয়ার করেই এলাকায় দখল রাখতে চান। এবং সেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়াতেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে এরা।

shyamal karmakar kuntak chattapadhya bamangachi saurav chowdhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy