Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Sankha Ghosh

‘এখন কেবল বিদায় নেওয়া’

ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ় আগেই নেওয়া হয়েছিল তাঁর। চিকিৎসায় সাড়াও দিচ্ছিলেন। ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে বাড়িতেই চিকিৎসার দরকারি বন্দোবস্ত করা হয়।

শঙ্খ ঘোষ। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

শঙ্খ ঘোষ। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২১ ০৬:০৬
Share: Save:

তিনি বলেছিলেন, ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো শব্দহীন হও’! কোভিড সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ে বুধবার তাঁর প্রস্থানও অনেকটাই নিঃশব্দ থেকে গেল।

লকডাউনের জনহীন শহর নয়! তবে ভিড় দৃশ্যত কম! শুক্রবারই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ৯০ বছরের প্রবীণ কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক চলে গেলেন এ দিন সকালে ৮টা নাগাদ।

ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ় আগেই নেওয়া হয়েছিল তাঁর। চিকিৎসায় সাড়াও দিচ্ছিলেন। ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে বাড়িতেই চিকিৎসার দরকারি বন্দোবস্ত করা হয়। তবু শেষরক্ষা হল না। তাঁর প্রয়াণসংবাদ পেয়েই উল্টোডাঙায় শঙ্খ ঘোষের বাসভবনের সামনে জড়ো হয়েছিলেন কিছু প্রিয়জন। যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু মুখ মাস্কে ঢাকা। পারস্পরিক পরিচয় থাকলেও বেশির ভাগকেই ভাল ভাবে চেনার জো নেই। সব মিলিয়ে শ’দেড়েক ছাত্রছাত্রী, কবিতা-প্রবন্ধের পাঠক, সুহৃদ বা তাঁর বাড়ির রবিবাসরীয় আড্ডার মুখ কয়েক জন। করোনার অভিঘাতে প্রয়াত প্রিয় কবি, শিক্ষক বা পিতৃপ্রতিম অভিভাবককে শেষ বার স্পর্শ করারও উপায় নেই। তবু নীরব শান্ত উপস্থিতিটুকুই অবিচ্ছেদ্য বাঁধনের গল্প বলে গেল।

শঙ্খ ঘোষের স্ত্রী, দুই কন্যা, তাঁদের পরিবারবর্গ, দুই ভাই এবং তাঁদের পরিজনেরা রয়েছেন। উল্টোডাঙার ঈশ্বরচন্দ্র আবাসনের বাড়ি থেকে সল্টলেকে একবার তাঁর সেজ ভাইয়ের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। কোভিড-বিধি মেনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলা আকাদেমি কোথাওই কবিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রাখা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কবির পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। বালুরঘাটের প্রচারসভাতেও তিনি ‘বাংলার গর্ব, অতিপ্রিয় কবিকে’ হারানোয় গভীর শোকের কথা বলেন। বিকেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নিমতলা শ্মশানে শঙ্খবাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু 'গান স্যালুট' কবির পছন্দ ছিল না। তাই ওই আচারটুকু বাদ রাখা হয়।

শেষকৃত্য নিচু তারে বাঁধা থাকলেও ভোট-আবহে বাংলার অগ্রগণ্য কবি, চিন্তাবিদের প্রয়াণ-সংবাদ রাজনৈতিক মহলেও ছাপ ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা বিজেপি-র জাতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডার শোকবার্তাও টুইটারে প্রকাশিত। অমিত শাহের বাংলা টুইটে আবার শঙ্খ ঘোষের অসামান্য কবিতায় সামাজিক চিত্রকে গভীর ভাবে অঙ্কন করার কথা। সমাজমাধ্যমে অনেকেরই তখন মনে পড়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বন্দি ভারাভারা রাওয়ের মুক্তির দাবিতে সংহতি প্রকাশ করে গত বছরই শঙ্খবাবুর স্বাক্ষরের কথা। শঙ্খের কৃত ভারাভারার কবিতার বাংলা ভাষান্তরেই তো লেখা হয়, ‘যখন কাঁপন লাগে জিভে/ বাতাসকে মুক্ত করে দেয় সুর/ গান যখন হয়ে ওঠে যুদ্ধের শস্ত্র / কবিকে তখন ভয় পায় ওরা/ কয়েদ করে তাঁকে, আর/ গর্দানে আরও শক্ত করে জড়িয়ে দেয় ফাঁস/ কিন্তু, তারই মধ্যে, কবি তাঁর সুর নিয়ে/ শ্বাস ফেলছেন জনতার মাঝখানে’!

অতিমারির বিধিনিষেধেও আজ দিনভর হৃদয়ে হৃদয়ে উজ্জ্বল শঙ্খ ঘোষের উপস্থিতি। নানা প্রতিবাদে, সঙ্কটে দিশা দেখানো কবির মৃত্যুতে অনেকের মধ্যেই চারিয়ে গিয়েছে অভিভাবক হারানোরও বোধ। নিজেকে কখনও বেশি প্রকট করে তোলা অপছন্দ করলেও কবি-শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ মানুষ ভালবাসতেন। এমনকি সব সময়েই আশপাশের সবার প্রয়োজনে এগিয়ে আসা মানুষটি কখন নিজের লেখা লেখেন, কাছের জনদের অনেকের কাছেও সে ছিল এক রহস্য। তিন দশক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় থেকেই তাঁর কণ্ঠস্বরের সমস্যা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে ফুসফুসেরও সমস্যা ছিল। পার্কিনসন্সে আক্রান্ত হওয়ার পরে সুহৃদদের সাহায্য নিয়ে লিখতেন। তবু মানুষের সঙ্গ ছাড়েননি। অতিমারিতে পারিপার্শ্বিক জীবনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। তবু গত ৫ ফেব্রুয়ারি, শেষ জন্মদিনেও তাঁকে দেখতে চলে আসা কাউকেই ফেরাননি। এর পরেও চলে গিয়েছিলেন গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় তাঁর সমসাময়িক সাহিত্যের পাঁচ জন দিকপাল বন্ধু সদ্যপ্রয়াত অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, সুধীর চক্রবর্তী, অরুণ সেনদের নিয়ে প্রদর্শনী, 'পাঁচটি তারার তিমিরে'। এ দিন উল্টোডাঙার বাড়ি থেকে শ্মশান পর্যন্ত দূর থেকে ‘স্যরের’ শবানুগমনে শামিল এক প্রবীণ ছাত্রী বলছিলেন, “শেষের দিকে ওঁর কথা অস্ফুট হয়ে গেছিল। ভাল ভাবে শোনা যেত না! কিন্তু স্নেহের পরশটা বোঝা যেত। চুপটি করে কিছু ক্ষণ কাছে বসতাম। কিংবা ফোনে ওঁর নিঃশ্বাসের শব্দটুকু পেতাম।”

জনপরিসর বা ভিড়ে আপাত সঙ্কুচিত মানুষটিই কিন্তু লিখেছিলেন ‘আমাকে ভুবন দাও, আমি দেব সমস্ত অমিয়’! তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে প্রিয়জনেদের সব সময়ের উৎকণ্ঠা পিছনে ফেলে শঙ্খ ঘোষ এখন অবাধে বাংলা ভাষাকে ভালবাসা সব ক’টি হৃদয়েই ছড়িয়ে পড়লেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sankha Ghosh Bengali Poet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE