Advertisement
E-Paper

শিল্পের ছবি আরও মলিন, বন্ধ হল হাওড়ার শতাব্দীপ্রাচীন রং কারখানা

রাজ্যে শিল্পের রংচটা ছবিটাকে আরও বেআব্রু করে দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীনতম রং কারখানা শালিমার পেন্টসের দরজা। বুধবার সকালে হাওড়ায় ১১৩ বছরের পুরনো কারখানার দরজায় কাজ বন্ধের (সাসপেনশন অব ওয়ার্ক) নোটিস ঝুলিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। যার ফলে কর্মহীন হয়ে পড়লেন স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় আড়াইশো শ্রমিক-কর্মচারী। একই সঙ্গে নোকিয়া-সিমেন্স, হিন্দ মোটর, জেসপ, ডানলপের পরে এ রাজ্যে সম্প্রতি বন্ধ হওয়া কারখানার তালিকায় যুক্ত হল আরও একটা নাম।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৪ ০৩:২১
কাজ বন্ধের নোটিস দেখছেন শ্রমিকরা। বুধবার হাওড়ার কারখানায়।  ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

কাজ বন্ধের নোটিস দেখছেন শ্রমিকরা। বুধবার হাওড়ার কারখানায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

রাজ্যে শিল্পের রংচটা ছবিটাকে আরও বেআব্রু করে দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীনতম রং কারখানা শালিমার পেন্টসের দরজা। বুধবার সকালে হাওড়ায় ১১৩ বছরের পুরনো কারখানার দরজায় কাজ বন্ধের (সাসপেনশন অব ওয়ার্ক) নোটিস ঝুলিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। যার ফলে কর্মহীন হয়ে পড়লেন স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় আড়াইশো শ্রমিক-কর্মচারী। একই সঙ্গে নোকিয়া-সিমেন্স, হিন্দ মোটর, জেসপ, ডানলপের পরে এ রাজ্যে সম্প্রতি বন্ধ হওয়া কারখানার তালিকায় যুক্ত হল আরও একটা নাম।

গত ১২ মার্চ আগুন লেগেছিল শালিমারের হাওড়ার কারখানায়। তার পর থেকেই বন্ধ ছিল উৎপাদন। প্রয়োজনীয় মেরামত করে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের কাছ থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ নেওয়ার আগে উৎপাদন চালু করা সম্ভবও ছিল না। সংস্থার দেওয়া কাজ বন্ধের নোটিসে অপারেশন বিভাগের প্রধান প্রবীণ আস্থানা লিখেছেন, মেরামতি করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ লগ্নি প্রয়োজন, তা এখনই করা অসম্ভব। আর সেই কারণেই কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

কিন্তু রাজ্যের শিল্পমহলের একটা বড় অংশ মনে করছে, আসল সমস্যা আরও গভীরে। সেটা হল, রঙের, বিশেষত দামি রঙের বাজারে পূর্ব ভারতের গুরুত্ব লাগাতার কমতে থাকা। এ দেশে ৩০ হাজার কোটি টাকার রঙের বাজারের ৩২%-ই পশ্চিম ভারতে। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে যথাক্রমে ২৬ ও ২৮%। সেই তুলনায় পূর্ব ভারতের বাজার মাত্র ১৪%।

এর প্রধান কারণ শিল্পের অভাব। রং লাগে শিল্পে আর বাড়িতে। শিল্প না থাকলে সেখানে রঙের চাহিদা যেমন কমে, তেমনই ধাক্কা লাগে সাধারণ মানুষের রোজগারেও। ফলে বাড়িতে লাগানোর রঙের চাহিদাও কমে। এই বিষাক্ত চক্রেই বন্দি হয়ে পড়েছে এ রাজ্যের রং শিল্প।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এক দিকে পূর্ব ভারতের বাজার ছোট, তার উপর সেই বাজারের বড় অংশই কব্জা করে রয়েছে অন্য চার সংস্থা। সেই কারণেই খরচাপাতি করে নতুন প্রযুক্তি এনে এ রাজ্যে কারখানা চালানোর উৎসাহ পাচ্ছে না শালিমার। সংস্থা সূত্রে খবর, হাওড়ার কারখানা নতুন করে চালু করতে খরচ হবে প্রায় ১২ কোটি টাকা। শুধু অগ্নি নির্বাপণের উপযুক্ত ব্যবস্থা তৈরি করতেই লাগবে ৪৫ লক্ষ টাকা। এই পরিমাণ টাকা খরচ করার চেয়ে নাসিক ও দিল্লির কাছের সিকান্দারাবাদের কারখানা থেকে রং এনে এখানে বিক্রি করাই তুলনায় লাভজনক হবে বলে মনে করছেন সংস্থার কর্তারা।

এ রাজ্যে হাওড়া ব্রিজ থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু বা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন রাঙিয়ে তোলার গৌরব আছে শালিমারের। এক সময় মেরিন পেন্টের (জাহাজের রং) বেতাজ বাদশাও ছিল তারা। কিন্তু এ রাজ্যের বন্দরে জাহাজ ভেড়ার অবস্থা মোটে আশাব্যঞ্জক নয়। ফলে সেই রঙের চাহিদাও নেই। তার উপর নতুন করে বড় শিল্প প্রায় আসছে না বললেই চলে। তা হলে আর চাহিদা তৈরি হবে কোথা থেকে?

শিল্পমহলের কর্ণধাররা বলছেন, বড় শিল্প না এলে শিল্পচিত্র যে বদলাবে না, সেটা এ রাজ্যের প্রশাসনিক কর্ণধাররা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। মুখ্যমন্ত্রী মুম্বইয়ে মুকেশ অম্বানী-সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করার পরে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু এ রাজ্য সম্পর্কে শিল্পমহলের যে ঐতিহাসিক অনীহা, তা দূর করার কোনও চেষ্টা তৃণমূল সরকার করেনি।

এ রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটানোর তোড়জোড় করলেও অন্যত্র কিন্তু নতুন কারখানা খুলছে শালিমার। এ বছরই চেন্নাইয়ে চালু হবে তাদের নতুন কারখানা। ঘটনাচক্রে পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া আরও দুই সংস্থা নোকিয়া-সিমেন্স এবং হিন্দ মোটরও চেন্নাইয়ে নতুন কারখানা খুলছে।

শালিমার পেন্টসের দরজা বন্ধ হওয়ার জন্য সংস্থার কর্তৃপক্ষকেই দুষছেন শ্রমিকরা। শ্রমিক আন্দোলনের জন্য এক দিনও কাজ বন্ধ হয়নি হাওড়ায়, এই দাবি করে তাঁদের অভিযোগ, কারখানা গোটাতেই চক্রান্ত করে আগুন লাগানো হয়েছিল গত মার্চে। বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়ন এআইটিইউসি নেতা পরিতোষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “১২ মার্চ আগুন লাগানো যে চক্রান্ত ছিল, তা এ দিনের নোটিস ঝোলানোয় স্পষ্ট।”

শ্রমিকদের অবশ্য অভিযোগ, আগুন লাগার দিন কারখানার ৪৫ হাজার লিটারের ট্যাঙ্কে জল ছিল না।

গঙ্গা থেকে পাইপে জল আনার ব্যবস্থাও কাজে লাগানো যায়নি। হাওড়া দমকল দফতরের অভিযোগ, অগ্নিকাণ্ডের পরই জানা গিয়েছিল দাহ্য পদার্থে ঠাসা ওই কারখানার ফায়ার লাইসেন্স নেই। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও তারা আজ পর্যন্ত কিছু জানায়নি। কারখানার তৃণমূল কর্মী ইউনিয়নের নেতা দেবাশিস সেন বলেন, “রাজ্যকে হেয় করতেই এই সিদ্ধান্ত। ওই সব এনওসি নেওয়ার কথা আসলে অজুহাত।”

হাওড়ার অতিরিক্ত শ্রম কমিশনার বিপ্লব মজুমদার বলেন, “পুরো ঘটনা শ্রম দফতরে জানানো হয়েছে। তারা বলেছে, খুব শীঘ্রই কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনগুলিকে আলোচনায় ডাকা হবে।” আজ, বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে তিনি বৈঠকে বসবেন বলে জানিয়েছেন শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। তাঁর কথায়, “যত শীঘ্র সম্ভব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।”

শ্রমিক সংগঠনগুলির নেতাদের অভিযোগ, কারখানা বন্ধের ভাবনা ছিল বলেই দু’দিন আগে স্থায়ী শ্রমিকদের নাসিক বা সিকান্দারাবাদে বদলির প্রস্তাব দেওয়া হয়। স্থানীয় সূত্রেও খবর, সপ্তাহখানেক আগে অস্থায়ী শ্রমিকদের ছাঁটাই করার

কথা বলা হয়েছিল ঠিকাদারদের।

শালিমার কর্তৃপক্ষের অবশ্য বক্তব্য, কারখানা ফের চালু করার চেষ্টা চলছে। এ রাজ্যের প্রতি তারা দায়বদ্ধ। আগুনে অ্যালুমিনিয়াম পেন্ট তৈরির যন্ত্রপাতি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাই অগস্ট-সেপ্টেম্বরেই কিছু দক্ষ কর্মীকে নিয়ে এই রং উৎপাদন ফের চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু শিল্পমহলের চোখে এ সব নেহাতই সব দিক সামলানো কূটনৈতিক বয়ান।

“এ রাজ্যের শিল্পচিত্র অনেক দিনই বিবর্ণ। সে দিক থেকে দেখলে রং কারখানা বন্ধ হওয়াটা রীতিমতো প্রতীকী,” মন্তব্য এক প্রবীণ শিল্পপতির।

shalimar paint factory howrah locked out
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy