E-Paper

বাল্যবিবাহ রুখতে ঋতু-কথার সঙ্গেই প্রচার গাড়িতে

তাই ঋতু-স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে নাবালিকা বিয়ে ও অকাল-মাতৃত্ব নিয়েও এ রাজ্যে সচেতনতা প্রচারের পথে হাঁটছেন ‘কলকাতার প্যাডম্যান’ শোভন মুখোপাধ্যায়।

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫ ০৯:৪৮
বাল্যবিবাহ রুখতে প্রচার চলবে এই গাড়ি নিয়েই।

বাল্যবিবাহ রুখতে প্রচার চলবে এই গাড়ি নিয়েই। নিজস্ব চিত্র।

গ্রামের ছোট্ট মেয়েটি ঋতুমতী হতেই নিজের অজানতে বদলে যায় তার জীবন। কারণ, তার সমাজের কাছে সেই দিন থেকে সে বিবাহযোগ্যা! ফলে স্কুল ছাড়িয়ে মাত্র ১৪-১৫ বছর বয়সেই শ্বশুরবাড়ি যেতে হয় তাকে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলে আসে সন্তান। অনেক সময়ে পুষ্টির অভাবে সন্তান প্রসবের সময়ে মারাও যায় এমন অনেক কিশোরী-মা। এ দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় আজও এটাই ভবিতব্য কিশোরীদের।

তাই ঋতু-স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে নাবালিকা বিয়ে ও অকাল-মাতৃত্ব নিয়েও এ রাজ্যে সচেতনতা প্রচারের পথে হাঁটছেন ‘কলকাতার প্যাডম্যান’ শোভন মুখোপাধ্যায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এই প্রচারাভিযান শুরু হচ্ছে। ঋতু-স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা, নাবালিকা বিয়ের কুফল এবং অকাল-মাতৃত্বের বিপদের বার্তা দিতে হাতে আঁকা গাড়ি নিয়েই গ্রামে গ্রামে ঘুরবেন শোভন ও তাঁর সঙ্গীরা।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯২-’৯৩ সাল থেকে ২০১৯-’২১, এর মধ্যে এ দেশে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে বাল্যবিবাহের হার (৫৪.২ শতাংশ থেকে ২৩.৩ শতাংশ)। কিন্তু তার মধ্যে বিহার ও ত্রিপুরার মতোই সামনের সারিতে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ অনুযায়ী, এ রাজ্যে ৪১ শতাংশ নাবালিকার অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায়, যা জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ! অর্থাৎ, রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্পও নাবালিকা বিয়ে এবং অকাল-মাতৃত্বের হার কমাতে পারেনি।

পরিবারের পিতৃতান্ত্রিকতা, স্কুলছুটের আধিক্য, বিকল্পের অভাব, আরও রোজগারের সম্ভাবনা— এর জেরেই আজও এ রাজ্যে বাড়ছে নাবালিকা বিয়ের সমস্যা। রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন তুলিকা দাসের ব্যাখ্যা, ‘‘আমরা জানি, কোভিডের পরে স্কুলছুট, বাল্যবিবাহ ও অল্পবয়সি ছেলেদের বাইরে কাজ করতে চলে যাওয়া বেড়ে গিয়েছিল। তার ফলে বর্তমানে কম বয়সে রোজগার শুরু করায় পরিবারও তাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে কোনও নাবালিকার সঙ্গে। আবার কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হলেও পারিবারিক শাসনের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বিয়ে করে নিচ্ছে অনেক কিশোরী। যেন বিয়েতেই সব সমস্যার সমাধান লুকিয়ে। স্কুলছুট হওয়ার সঙ্গেও বাল্যবিবাহের সরাসরি যোগ রয়েছে। এ এক দুষ্টচক্রের মতো।’’

এ ছাড়া বিয়ের পরে পারিবারিক হিংসার শিকার বা পাচার হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। চিকিৎসকদের মতে, কিশোরী-মাতৃত্বের ফলে যেমন শৈশব নষ্ট হয়, মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে, তেমনই মাতৃত্বে ঝুঁকিও বাড়ে। অপুষ্টিজনিত কারণে প্রসবকালে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। অভিভাবকদের অজ্ঞতা, পারিবারিক দারিদ্রও এর জন্য কম দায়ী নয়।

ইতিমধ্যে বাল্যবিবাহ রুখতে জেলায় জেলায় কর্মশালার উপরে জোর দিয়েছে শিশু সুরক্ষা কমিশন। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সব পক্ষকে নিয়ে ওয়টস্যাপ গ্রুপ তৈরি করে সাফল্য মিলেছে। তবে জনমানসে সচেতনতা ছড়াতে ঋতু-কথার সঙ্গেই বাল্যবিবাহ নিয়ে বার্তা দিতে চাইছেন শোভন। তিনি বলছেন, ‘‘মাসিক শুরুর সঙ্গে বিয়ে ও মাতৃত্বের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। তাই ঋতু-স্বাস্থ্যের পাশাপাশি, নাবালিকা বিয়ে ও অকাল-মাতৃত্ব নিয়েও গাড়িটির গায়ে ছবি আঁকা হয়েছে। এ ছাড়া গাড়িতে থাকাপ্রোজেক্টরের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে তথ্যচিত্র, প্রেজ়েন্টেশন দেখিয়ে সকলকে সচেতন করাটাই লক্ষ্য।’’

দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ের গ্রাম থেকেই শুরু হচ্ছে প্রচারাভিযান। আগামী কয়েক মাসে গোসাবা, জয়নগর ১ এবং ২, বাসন্তী, ভাঙড় ১ (যেখানে কিশোরী-মাতৃত্বের হার ১৫ শতাংশ বা তার বেশি)যাবে গাড়িটি। ভবিষ্যতে অন্য জেলা এবং কলকাতার বস্তি এলাকাতেও এ ভাবে প্রচার করা হবে বলে পরিকল্পনায় রয়েছে।

এই উদ্যোগে শোভনের পাশে রয়েছে জেলা প্রশাসন এবং শিশু সুরক্ষা কমিশন। গত তিন বছর ধরে রাজ্য সরকার ও ইউনিসেফ একযোগে বাল্যবিবাহ-রোধে জেলায় জেলায় কাজ করছে। তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, স্কুলছুটের সংখ্যা, নারী পাচারের আধিক্য-সহ একাধিক কারণে নাবালিকা বিয়ের হার অনেকটাই বেশি। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মুক্তিসাধন মাইতি জানাচ্ছেন, ক্যানিং সাব-ডিভিশনের ব্লকগুলিতে নাবালিকা বিয়ে ২০ শতাংশেরও বেশি, অকাল মাতৃত্বের হার ১৫ শতাংশের বেশি। তাঁর কথায়, ‘‘তাই সারা বছর এ নিয়ে সরকারি তরফে কাজ হলেও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিও এগিয়ে এলে ভাল হয়। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে নাবালিকা বিয়ে ঠেকানো যেতে পারে। অকাল-মাতৃত্ব রুখতে গর্ভনিরোধক ওষুধের ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতা,ঋতুকালীন-স্বাস্থ্য সচেতনতায় জোর দিতে হবে। ঋতু-স্বাস্থ্য অবহেলিত হলে নানাবিধ অসুখের কারণে বন্ধ্যত্বের আশঙ্কাও থাকে। তাই গাড়িতে একসঙ্গে সব কিছুর প্রচার চালানো শুভ উদ্যোগ।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

South 24 Parganas

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy