Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রয়োজন কমেছে, বিস্মৃত কোঁঙা

সে গাছের ফুল ফোটার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকতেন নানুরের দুলাল বাউড়ি, মঙ্গলা বাউড়ি, লক্ষণ বাউড়িরা। সে গাছ থেকে বাবা-কাকাদের দড়ি তৈরি করতে দেখেছেন ময়ূরেশ্বরের ডাঙাপাড়ার গঙ্গাধর দে, ফটিকচন্দ্র দে’রা। একদিন সে গাছের পাতা থেকেই দড়ি তৈরির কারখানা ছিল রাজনগরের সিসাল ফার্মে। সে গাছের নাম কোঁঙা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন হারিয়ে যাচ্ছে চারপাশের প্রকৃতি থেকে নানা গাছ, তেমনই হারিয়ে যাচ্ছে এই কোঁঙা গাছটিও।

অর্ঘ্য ঘোষ
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৫ ০২:৩০
Share: Save:

সে গাছের ফুল ফোটার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকতেন নানুরের দুলাল বাউড়ি, মঙ্গলা বাউড়ি, লক্ষণ বাউড়িরা। সে গাছ থেকে বাবা-কাকাদের দড়ি তৈরি করতে দেখেছেন ময়ূরেশ্বরের ডাঙাপাড়ার গঙ্গাধর দে, ফটিকচন্দ্র দে’রা। একদিন সে গাছের পাতা থেকেই দড়ি তৈরির কারখানা ছিল রাজনগরের সিসাল ফার্মে। সে গাছের নাম কোঁঙা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন হারিয়ে যাচ্ছে চারপাশের প্রকৃতি থেকে নানা গাছ, তেমনই হারিয়ে যাচ্ছে এই কোঁঙা গাছটিও।

‘‘মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই হারিয়ে যাচ্ছে। এমন করে কত গাছই তো প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেল!’’ বলছিলেন এক জেলারই এক প্রবীণ। উদ্ভিদবিদদের তাই অভিমত, অ্যাগেভ সিসালানা বিজ্ঞান সম্মত নামের এই কাঁটা গাছটি এদেশে আনা হয়েছিল বহু আগে। এর সংরক্ষন প্রয়োজন। না হলে অচিরেই কল্যাণে ব্যবহৃত গাছটি একেবারেই হারিয়ে যাবে। কথায় কথায় মনে পড়ে যায়, এই গাছটিকে নিয়ে প্রচলিত ছড়াটি। ‘কোঁঙা- কোঁঙা- কোঁঙা, তুই বড়ো বোঙা/ তোর হাড় খায় মাসও খায়, তবু তোর মুখে রা’টি নাই।’

ছন্দের বিচারে পলকা হলেও, একসময় গ্রাম গঞ্জে প্রচলিত এই ছড়াটিই বুঝিয়ে দেয় কোঁঙার বহুল ব্যবহারের কথা। প্রবীণেরা বলেন, সেই কারণেই একসময় কোঁঙা গাছ লাগানো হত। একসময়, মাটির প্রাচীরের ছাউনি হিসাবেও ব্যবহার করা হত কোঁঙার পাতা। কেউ কেউ বেড়া বা বাড়ির শেষ সীমানা বোঝাতেও কোঁঙাগাছ ব্যবহার করতেন। সেক্ষেত্রে দূর-দূরান্ত থেকেও পর্যাপ্ত চারা নিয়ে আসতেন গ্রামের মানুষ।

ময়ূরেশ্বরের তিলডাঙা গ্রামের ৬৪ বছরের সুধীর মণ্ডল, লাভপুরের দাঁড়কার ৭০ বছরের কাশিনাথ দাসরা বলেন, ‘‘তখন গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ মানুষ সংগতির অভাবে কোঁঙার পাতার বেড়া বেঁধে কিংবা গাছ পুঁতে প্রাচীরের কাজ চালাতেন। আমরাও মাটির প্রাচীরের উপরে ছাউনি হিসাবে ওই গাছের পাতা ব্যবহার করেছি। এখন সে সব কোথায়!’’ একসময় গবাদি পশুর চিকিৎসা করছেন ময়ূরেশ্বরের ঢেকার ৮০ বছরের বৃদ্ধ বিজয় মণ্ডল। নানুরের কীর্ণাহার ২ নং পঞ্চায়েত এলাকায় প্রাণীবন্ধু হিসাবে কাজ করছেন সঞ্জিত মণ্ডল। তাঁরা জানান, বছর ১৫/২০ আগেও গবাদি পশুর ওষুধ এত সুলভ এবং সহজ প্রাপ্য ছিল না। তখন গরু-মোষের কাঁধে ঘা হলে কোঁঙা পাতা থেঁতলে লাগানো হত। পাতা পুড়িয়ে তার রস লাগালেও গবাদি পশুর ব্যথা নিরাময় ঘটত।

কোঁঙা ফুল ফোটার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকতেন নানুরের উচকরণের যে দুলাল বাউড়ি, মঙ্গলা বাউড়ি, লক্ষণ বাউড়িরা, তাঁরা পুরুষানুক্রমে জমিদার বাড়ির পাশাপাশি নিজেদের জীবিকার জন্য পালকি বইছেন। তাঁরা জানান, ৪/৫ বছর পর পরিণত কোঁঙা গাছে একটি দণ্ডের ফুল আসে। ফুল ঝড়ে যাওয়ার পর ওই দণ্ডটি অত্যন্ত মজবুত হয়ে ওঠে। পালকির বাঁটের জন্য একসময় দণ্ডটির প্রচণ্ড কদর ছিল। ২০০/২৫০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠত। বলেন, ‘‘ফুল ফোটার খবর পেলেই গাছ মালিককে বায়না পর্যন্ত দিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ জাহাজের মাস্তুলের জন্যও চড়া দাম দিয়ে ওই দণ্ডটি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলত।’’

এ গাছের উপযোগিতা নিয়ে ময়ূরেশ্বরের ডাঙাপাড়ার গঙ্গাধর দে, ফটিকচন্দ্র দে’রা বললেন, ‘‘কোঁঙা পাতার সব থেকে বহুল ব্যবহার ছিল দড়ি তৈরির ক্ষেত্রে। পাট-শনের মতো কোঁঙা পাতার তন্তু পাকিয়েও বাবা কাকাদের দড়ি তৈরি করতে দেখেছি। ওই পাতা থেকে দড়ি তৈরির কারখানা ছিল রাজনগরের সিসাল ফার্মে। চাষও হত ওই গাছের। সেই কারখানা আজ বন্ধ।’’

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক শমিত রায় বলেন, ‘‘বিদেশি ওই গাছটির নানা উপকারিতা রয়েছে। এক সময় প্রায় প্রতিটি গ্রাম গঞ্জে ব্যাপক হারে ওই গাছ দেখা যেত। অনাদর এবং নগর সভ্যতার গ্রাসে ওই গাছ অবলুপ্তপ্রায়। প্ল্যান্ট আকারে চাষ করেলে, মানব কল্যাণে ওই গাছ উপকারে লাগতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE