Advertisement
E-Paper

পরিবর্তন! এ বার শোভনের সইয়েও

তাঁরা জানাচ্ছেন, হাতের লেখা, সই নির্ভর করে মানসিক পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপরে। পরিস্থিতি পাল্টালে হাতের লেখাও পাল্টায়। তেমন পরিবর্তন ধরা পড়েছে কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সইয়েও!

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:৫২
আগে-পরে: পুর-নথি (উপরে) এবং ইস্তফার চিঠিতে সই।

আগে-পরে: পুর-নথি (উপরে) এবং ইস্তফার চিঠিতে সই।

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পরে পাল্টে গিয়েছিল আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সই। পেশাদারি ও ব্যক্তিগত সঙ্কট ছাপ ফেলেছিল সইয়ের উপর। হাতের লেখা বিশারদদের (গ্রাফোলজিস্ট) গবেষণায় পরবর্তীকালে তেমনই ধরা পড়েছিল। কারণ, তাঁরা জানাচ্ছেন, হাতের লেখা, সই নির্ভর করে মানসিক পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপরে। পরিস্থিতি পাল্টালে হাতের লেখাও পাল্টায়। তেমন পরিবর্তন ধরা পড়েছে কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সইয়েও!

কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের পদত্যাগপত্রের প্রতিলিপি দেখে গ্রাফোলজিস্টদের একাংশ জানাচ্ছেন, যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি সুপ্ত অবস্থায় ছিল, সেগুলি পদত্যাগপত্রের সইয়ে ফুটে উঠেছে। তাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁর সম্মানবোধ (সেন্স অব অনার) যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে নিজের অনুভূতিগুলোকে আরও স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করার তাগিদ (নিড টু এক্সপ্রেস অ্যাবাউট হিমসেল্ফ) ও আত্মরক্ষার (ফিলিং অব সেল্ফ প্রোটেকশন) চেষ্টা। বেড়েছে পেশাদারি জীবনের সঙ্গে যুক্ত উৎকণ্ঠাও।

গ্রাফোলজিস্ট মোহন বসু বলেন, ‘‘কেউ তাঁকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করছে, সেটা যে মানতে পারছেন না, তা শোভনবাবুর সইয়ে স্পষ্ট। অক্ষরের ফর্মেশনে ধরা পড়েছে, নিজে যা মনে করছেন, তা স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করতে চাইছেন।’’ প্রসঙ্গত, মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগপত্রে শোভন লিখেছিলেন, ‘আন্ডার কম্পালশন’ বা ‘বাধ্য হয়ে’ ওই পদ ছাড়ছেন। যদিও মেয়র পদ থেকে পদত্যাগের ক্ষেত্রে তেমন কিছু উল্লেখ করেননি তিনি। তবে জানিয়েছেন, দল নির্দেশ দিলে কাউন্সিলর-বিধায়কের পদও ছেড়ে দেবেন। ইস্তফার সইয়ে যে ‘সেল্ফ অ্যা‌সারটিভনেস’ ধরা পড়েছে, এই বক্তব্য তারই প্রতিফলন বলে মনে করছেন মোহনবাবু।

আরও পড়ুন: জঙ্গলমহলে আরও আড়াই লক্ষ রেশন কার্ড

রিচার্ড নিক্সনের সই। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির আগে (উপরে) ও পরে।

২০১৭ সালের শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ২০১৮ সালের নভেম্বরের শোভন চট্টোপাধ্যায়ের অনেকটাই ফারাক বলে সই দেখে মনে হয়েছে মোহনবাবুর। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৭ সালের শুরুর দিকে সইয়ে তাঁর শারীরিক সমস্যার বিষয়টি বেশি ধরা পড়েছে। ব্যক্তিগত জীবনকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিতেন বলে মনে হচ্ছে। আত্মরক্ষার বিষয়টি তখনও ছিল।’’ অবশ্য হস্তলেখা বিশারদেরা জানাচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষমতাবানের সইয়ের বিশেষত্ব হল—‘ফিলিং অব সেল্ফ প্রোটেকশন’।

আরও পড়ুন: ‘সিল’ করা হল মেয়রের টেবিলে থাকা ফাইল

মোহন বসু। —নিজস্ব চিত্র।

২০১৭-র পুরসভার নথির প্রতিলিপিতে শোভনবাবুর যে সই মোহনবাবু দেখেছেন, তাতে পুরো নাম লেখা ছিল না। তবে মোহনবাবুর কথায়, ‘‘ওই সময়ে তিনি যদি পুরো নামও সই করতেন, তাতেও ফারাকটা স্পষ্ট থাকত। কারণ, গ্রাফোলজিতে প্রথম অক্ষরের গুরুত্ব সব থেকে বেশি। ফলে সংক্ষিপ্ত সই বা পুরো নাম সইয়ে পার্থক্য হয় না। দেখা যাচ্ছে, অন্য সইয়ে যে ‘এস’ ব্যবহার করেছেন শোভনবাবু, সেই ‘এস’ তুলনামূলক ভাবে স্তিমিত। কিন্তু পদত্যাগপত্রের ‘এস’ অনেক বলিষ্ঠ, সে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করছে।’’
‘ক্লিনিকাল গ্রাফোলজি’ নিয়ে কাজ করছেন স্বপনকুমার চন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘একই মানুষের লেখার ধরন বদল হয়ই। হ্যান্ড রাইটিং বলে কিছু হয় না। আসল হল ব্রেন রাইটিং। আমাদের মস্তিষ্কই ঠিক করে দেয় যে লেখার ধাঁচ, অক্ষরের প্যাটার্ন কী হবে।’’
মস্তিষ্কই যে লেখার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে, তা প্রমাণের জন্য ১৮৯৫ সালে সাইকোলজির অধ্যাপক উইলিয়াম প্রেয়ার গবেষণা করেছিলেন। দু’হাতই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত, এমন কয়েক জনকে মুখ বা পায়ের মাধ্যমে লেখা শিখিয়েছিলেন তিনি। দেখা গিয়েছিল, দুর্ঘটনায় হাত খোওয়া যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁদের অক্ষরের যে ধাঁচ ছিল, পা বা মুখ দিয়েও সেই ধাঁচে লিখছেন তাঁরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান তথা মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, ‘‘কারও খুব মানসিক চাপ থাকলে হাতের লেখায় কয়েকটি চিহ্ন ফুটে ওঠে। লেখার টানগুলোর মধ্যে মানসিক অবস্থান ধরা পড়ে।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অভিজিৎ মজুমদারও বলেন, ‘‘ভাষাতত্ত্বে স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান নামে একটি ভাগ আছে। মস্তিষ্ক যে ভাবে যখন কাজ করে, তার প্রভাব লেখার উপরেও পড়ে।’’ সে কারণে বহু সংস্থা, স্কুল-কলেজ, পুলিশ হস্তলেখা বিশারদদের সাহায্য নেয়। কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘যে সমস্ত নথি সন্দেহজনক (কোশ্চেনড ডকুমেন্ট), সে সব হস্তলেখা বিশারদদের কাছে পাঠানো হয়। কারণ, প্রত্যেকের অক্ষরের ধাঁচ আলাদা। তাই কোনটা আসল, কোনটা নকল, বোঝা যায়।’’
যেমন জনসংযোগের ক্ষেত্রে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের সকলেরই সইয়ের প্রথম অক্ষর খুব ‘স্ট্রং’ হয়। শোভনবাবুর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে বলে জানাচ্ছেন মোহনবাবু। তবে অক্ষরের মূল আদল অপরিবর্তিত থাকলেও সমস্যা-সঙ্কটে সেই ধাঁচে বদল হয়। যেমন হয়েছিল নিক্সনের। বেসরকারি জনসংযোগ সংগঠনের তরফে প্রকাশিত বইয়ে দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তফার পরে নিক্সনের সইয়ের অক্ষর আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। আক্ষরিক অর্থে যাকে বলে ধুলোয় মিশে যাওয়া, অক্ষরগুলো তেমন সমান্তরাল হয়ে গিয়েছিল।
একই অবস্থা হয়েছিল নেপোলিয়ন বোনাপার্টেরও। তাঁর সই এত বদলেছিল যে এক জন মনস্তত্ত্ববিদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘হি স্টার্টস আউট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অ্যান্ড এন্ডস আপ নেপোলিয়ন ব্লোনঅ্যাপার্ট!’

Sovan Chatterjee Signature শোভন চট্টোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy