আদানি গোষ্ঠী তাজপুরের গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প থেকে বিদায় নিয়েছে কি না, তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে অনেক দিন ধরেই। সম্প্রতি আদানিদের বিরুদ্ধে শেয়ার দর বাড়িয়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় তৈরি হয়। এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে সেই জল্পনা আরও বৃদ্ধি পেল।
বুধবার বিধানসভায় বাজেট পেশ করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তার পর সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই বৈঠকে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাজপুরে কি আদানিদের টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে? জবাবে মুখ্যমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘‘এর উত্তর সিএস (মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ) দেবেন। এ বিষয়ে আমরা আইনি শলাপরামর্শ নিচ্ছি।’’
টেন্ডার-প্রক্রিয়ায় তাজপুর বন্দর গড়ার ক্ষেত্রে আদানিদের বেছে নিয়েছিল রাজ্য সরকার। রাজ্য মন্ত্রিসভা তাদের ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’ দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্মতি দিয়েছিল। ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর সরকারি বিজয়া সম্মেলন অনুষ্ঠানে গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার করণ আদানির হাতে তা তুলেও দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ঠিক হয়েছিল, গ্রিনফিল্ড প্রযুক্তিতে ওই বন্দর তৈরিতে ১৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে। পরিকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ হবে আরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। তখনও পর্যন্ত প্রস্তুতি নিয়ে কোনও প্রশ্ন না-থাকলেও, ২০২৩ সালে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরে আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে কার্যত অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল রাজ্য প্রশাসনের অন্দরে।
ওই বছর বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে তাজপুরের বন্দরে আদানিদের লগ্নি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরিও হয়েছিল। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে শিল্পপতিদের সামনে মুখ্যমন্ত্রী তাজপুরের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “আপনারা দরপত্রে অংশ নিতে পারেন।” তার পরেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি আদানি গোষ্ঠী ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত তাজপুর বন্দর প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছে?
জল্পনার আবহে রাজ্যের শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেছিলেন, “তাজপুর বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক আগ্রহপত্র (লেটার অফ ইনটেন্ট) দরপত্রে সর্বোচ্চ দর হাঁকা অ্যাপসেজ (আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকনমিক জ়োন) সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল। তার পরে কেন্দ্রীয় সরকারের চারটি মন্ত্রক—স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, বিদেশ ও জাহাজ মন্ত্রকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র চাওয়া হয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক শর্তযুক্ত নিরাপত্তা ছাড়পত্র দিয়েছে। তার সঙ্গে কিছু পর্যবেক্ষণও জানিয়েছে। এ নিয়ে রাজ্য সরকার ও আদানি গোষ্ঠী কাজ করছে, আলোচনা চালাচ্ছে। স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। কথাবার্তা চলছে।” কী সেই পর্যবেক্ষণ, তা অবশ্য বলা যাবে না বলে জানিয়েছিলেন শশী। তিনি জানান, বিদেশ, প্রতিরক্ষা, জাহাজ— কেন্দ্রীয় সরকারের এই তিনটি মন্ত্রকের ছাড়পত্র এসে গিয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে শিল্পমহলের সামনে নতুন করে দরপত্রের কথা কেন বলেছিলেন? এর কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য রাজ্যের মন্ত্রী দেননি সেই সময়ে। শশী শুধু বলেছিলেন, “আমি যা বলছি, মুখ্যমন্ত্রীর তরফেই বলছি।” রাজ্যের অবস্থান স্পষ্ট করতে তিনি ওই বিবৃতি একাধিক বার বাংলা ও ইংরেজিতে পড়ে শুনিয়েছিলেন। আদানি গোষ্ঠী এখনও তাজপুর বন্দর নির্মাণের প্রক্রিয়ায় যুক্ত তো? মন্ত্রী উত্তরে স্পষ্ট করে বলেন, “হ্যাঁ। আমাদের আলোচনা চলছে।”
মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের পরে প্রশ্ন উঠেছিল, তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের লাগাতার আদানি গোষ্ঠীকে আক্রমণের ফলেই আদানি গোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছে কি না! এর জবাবে শশী এক বার বলছিলেন, ‘‘রাজনীতির সঙ্গে উন্নয়নের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ তৃণমূল সাংসদ মহুয়ার আদানি গোষ্ঠীকে নিশানা ও তা ঘিরে বিতর্ক এবং রাজ্য সরকারের সঙ্গে শিল্পপতিদের সম্পর্ক তথা বা রাজ্যে আদানিদের লগ্নি, এই বিষয়গুলি রাজ্য সরকার আলাদা ভাবে দেখছে বলেও জানিয়েছিলেন শশী। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্যে সেই পুরনো জল্পনাই আবার ফিরে এল।