ফাইল চিত্র।
যার কাজ, তারেই সাজে। অন্যদের দায়িত্ব দিলে ট্রেনের প্রাযুক্তিক স্বাস্থ্যের ভাল-মন্দ বোঝা সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণে লোকবল কম। এই অবস্থায় যাঁদের টেকনিক্যাল বা প্রাযুক্তিক জ্ঞান কম, সেই ট্রেনচালকদের সফর শুরু করার আগে ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভের নীচের অংশ বা আন্ডার-গিয়ার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে! ময়নাগুড়ির দুর্ঘটনার পরে রেল বোর্ডের একটি নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ট্রেন কোনও স্টেশনে একটু বেশি সময়ের জন্য থেমে থাকলে এই কাজটা করতে হবে চালকদেরই।
ওই নির্দেশিকার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক প্রাক্তন ও বর্তমান রেলকর্তা। ইঞ্জিনের নীচের অংশে কোনও রকম অস্বাভাবিকতা আছে কি না, দেখামাত্র তা বোঝার মতো প্রশিক্ষণ ট্রেনের লোকোপাইলট বা চালকদের আদৌ থাকে কি না, উঠছে সেই প্রশ্ন। এই ‘তৎপরতা’র আড়ালে ট্রেনের চলাচল বা অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত কর্মী এবং আধিকারিকদের উপরে যথেচ্ছ চাপ দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের বড় ফাঁকফোকর আড়াল করার চেষ্টা চলছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। নিয়োগের অভাবে রেলের সেফটি ক্যাটেগরিতে বহু পদ ফাঁকা। অপারেশন বা ট্র্যাফিক বিভাগের কর্মীদের একক তৎপরতার উপরে এ ভাবে চাপ বাড়িয়ে বিপত্তি ঠেকানো কতটা সম্ভব, সেই প্রশ্নও তুলছেন কর্তাদের অনেকে।
এক রেলকর্তা বলেন, ‘‘রেল বোর্ডের তরফে চালকদের ট্রেনের নীচের অংশ পরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হাস্যকর। চালকেরা ইঞ্জিনের প্রযুক্তিগত দিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। একমাত্র ইঞ্জিন ছোটার সময় কোনও সমস্যা হলে সেটা তাঁরা ধরতে পারেন। লোকো ইনস্পেক্টরেরা কিসের ভিত্তিতে ময়নাগুড়ির দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের ইঞ্জিনকে ফিট সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, তা দেখা প্রয়োজন।’’
যাত্রী-সুরক্ষার প্রশ্নে রেলের প্রস্তুতিকে সংশয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে ময়নাগুড়ির দুর্ঘটনা। ট্র্যাক নবীকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার-সহ হরেক পদক্ষেপ নিয়ে রেল ঢালাও প্রচার চালালেও ভিতরের ফাঁকফোকর বেআব্রু হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন রেলকর্তাদের একাংশ। পরিস্থিতি সামলাতে মরিয়া রেল বোর্ড সব জ়োনকেই নজরদারিতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে, আবহাওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত প্রস্তুতি নিয়ে আশঙ্কার কারণে বুধবার দেশে চার শতাধিক ট্রেন বাতিল করতে হয়েছে।
রেল বোর্ডের চাপের মুখে সংশ্লিষ্ট সব জ়োনই কোচ, ইঞ্জিন, লাইন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের বাড়তি সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কোনও অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লে তৎক্ষণাৎ জানাতে বলা হয়েছে স্টেশনমাস্টার এবং পয়েন্টসম্যানদের। উত্তর সীমান্ত রেলের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের বড় অংশের অভিযোগ, ডিভিশন স্তরের আধিকারিকদের অধিকাংশই নজরদারির কাজ অধস্তনদের উপরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। একমাত্র জেনারেল ম্যানেজারের পরিদর্শনের সময় তাঁদের কিছুটা তৎপরতা চোখে পড়ে।
ময়নাগুড়ির দুর্ঘটনায় বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের ওয়্যাপ-৪ শ্রেণির ইঞ্জিনের ট্র্যাকশন মোটর খুলে পড়ার কথা জানা গিয়েছে। রেলের আধিকারিকদের বক্তব্য, ওই শ্রেণির ইঞ্জিনে ‘অ্যাক্সেল হাং অ্যান্ড নোজ় সাসপেন্ডর ট্র্যাকশন’ মোটর থাকে। এই ধরনের মোটর যে-ভাবে অ্যাক্সেলের সঙ্গে আটকানো থাকে, তাতে তা খুলে আসা কার্যত অসম্ভব বলে তাঁদের অভিমত। মোটরের সঙ্গে যুক্ত নোজ় সাসপেন্ডরও সেফটি বোল্ট দিয়ে আটকানো থাকে। ময়নাগুড়িতে ওই সেফটি বোল্ট খুলে বা ভেঙে গিয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাইরে থেকে ট্রেনচালকের পক্ষে ওই সমস্যা ইঞ্জিনের নীচে উঁকি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছেন রেল আধিকারিকদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, ওই ইঞ্জিন তৈরির সময় অথবা তার রক্ষণাবেক্ষণের সময় বড়সড় কোনও ত্রুটি ঘটে থাকতে পারে।
ময়নাগুড়ির দুর্ঘটনা যাত্রী-সুরক্ষা নিয়ে সরকারি দাবির বেলুন আকস্মিক ভাবে চুপসে দেওয়াতেই এমন এলোপাথাড়ি নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে বলে রেলের কর্মী ইউনিয়নগুলির অভিযোগ। ইস্টার্ন রেলওয়ে মেনস ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অমিত ঘোষ বলেন, ‘‘সারা দেশেই রেলের সেফটি ক্যাটেগরির বহু পদ ফাঁকা। অনেক কর্মীকেই অমানুষিক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বিপত্তি এড়াতে গেলে ওই সব পদে দ্রুত কর্মী নিয়োগ করা দরকার। লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ করে সমস্যার সমাধান হবে না।’’
যাত্রী-সুরক্ষার প্রশ্নে নজরদারি বাড়ানোর জন্য পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার নির্দেশ দিয়েছেন। ওই রেলের এক কর্তা বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট কোনও বিভাগ নয়, ট্রেন চলাচলের সঙ্গে যুক্ত সকলকেই যাত্রী-সুরক্ষার ব্যাপারে সজাগ থাকার কথা বলা হয়েছে। সামগ্রিক নজরদারি বাড়লে বিপত্তি এড়ানো সহজ হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy