আমচুরির অপবাদে এক স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে খুন করার অভিযোগে উত্তেজনা ছড়়াল ঠাকুরপুকুরে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত ছাত্রের নাম অনিরুদ্ধ বিশ্বাস (১৮)। তার বাড়ি ঠাকুরপুকুরের সত্যজিৎ পার্ক এলাকায়। পুলিশ এই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের নাম চিন্ময় সর্দার ও বিনোদ বাল্মিকী। তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করেছে পুলিশ। বস্তুত, চুরির অপবাদে ঠাকুরপুকুরে পিটিয়ে এ ভাবে ছাত্রের মৃত্যু ডায়মন্ড হারবারে মোষ চুরির অপবাদে ছাত্রকে পিটিয়ে মারার স্মৃতি উস্কে দিল।
স্থানীয় সূত্রে খবর, ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের পিছনে সত্যজিৎ পার্কে অনিরুদ্ধ বিশ্বাসের বাড়ি। কয়েক দিন ধরে জন্ডিসে ভুগছিল অনিরুদ্ধ। শুক্রবার বিকেলে পাড়ার বন্ধু সুপ্রতিম বিশ্বাসের সঙ্গে বাড়ির বাইরে বেরোয়। বাড়ি থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরত্বে ঠাকুরপুকুরের হরিরবাগানে একটি কুয়োর সামনে দুই বন্ধু বসে গল্প করছিল। পুলিশ জানিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যা সওয়া ৬টা নাগাদ ঠাকুরপুকুর পূর্বপাড়ার বাসিন্দা চিন্ময় সর্দার তার বাড়িতে আমচুরির সন্দেহে অনিরুদ্ধ ও সুপ্রতিমকে বেধড়ক মারতে শুরু করে। ক্রমাগত কিল, ঘুষি, লাঠির আঘাতে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়ে অনিরুদ্ধ। সুপ্রতিমের কথায়, ‘‘দু’জন মিলে তখন কথা বলছিলাম। হঠাৎই দেখি, এক ব্যক্তি দু’জনকে তাড়া করে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। তাড়া খাওয়া দু’জন আমাদের সামনেই উধাও হয়ে যাওয়ার পর ওই ব্যক্তি আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আর এক ব্যক্তি তখন বলে ওঠে, যে দু’জন পালিয়ে গেল তারা এদেরই বন্ধু। তার পরই দু’জনে মিলে আমাদের উপর বেধড়ক মারধর শুরু করে।’’ সুপ্রতিম জানায়, দু’জনে মদ্যপ অবস্থায় ছিল। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে অনিরুদ্ধ ও আমাকে বেধড়ক মারধর করার পর অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়। তবে আমার তুলনায় অনিরুদ্ধের উপর মারধর বেশি হয়েছিল।’’ এই ঘটনার পরেই অনিরুদ্ধের বাবা ও মা’কে টেলিফোনে বিস্তারিত জানান সুপ্রতিম। খবর পেয়ে সুপ্রতিমের মা-সহ পাড়ার বন্ধুরা এসে তাকে বাড়ি নিয়ে যান। শনিবার অনিরুদ্ধকে প্রথমে ঠাকুরপুকুরের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে রবিবার তাকে একবালপুরের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার রাত ১০টা নাগাদ মৃত্যু হয় অনিরুদ্ধের।
একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল অনিরুদ্ধের বাবা বিশ্বজিৎ ও মা ঝর্ণা বিশ্বাস। ছেলেকে যে ভাবে আমচুরির মিথ্যা অপবাদে খুন করা হল তা মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না অনিরুদ্ধের পাড়ার বাসিন্দারা। বেহালার আর্য বিদ্যামন্দিরের কৃতী ছাত্র অনিরুদ্ধ ছোট থেকে বরাবরই পড়াশোনায় ভাল। ২০১৪-য় ৬টি বিষয়ে লেটার নিয়ে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ, চলতি বছরে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম শ্রেণিতে পাশ। আশুতোষ কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করবে বলে ফর্ম তোলা হয়েছিল। এরই মধ্যে যে ভাবে মিথ্যা চুরির অপবাদে তাকে পিটিয়ে খুন করা হল তাতে শোকে মুহ্যমান ঠাকুরপুকুরের সত্যজিৎ পার্কের বাসিন্দারা। এ দিন অনিরুদ্ধের বাড়িতে ভিড় করা পাড়ার বাসিন্দাদের মুখে একটাই কথা, বরাবরই মেধাবী ছেলে ছিল। ও কখনও চুরি করতেই পারে না। এ দিন অনিরুদ্ধের বাড়িতে আর সবার সঙ্গে কথা বললেও দেখা যায়নি তাঁর মা ঝর্ণাদেবীকে। অনিরুদ্ধর মাসি সীমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘রাত থেকেই একটি ঘরে একা রয়েছেন দিদি। কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না। একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকেই এই অবস্থা।’’
আরও পড়ুন : মন্ত্রীর ফোন হোল্ডে রাখার খেসারত, ‘পদত্যাগ’ ও ‘কর্মহীন’ মহিলা আইপিএস
ঘটনার পর পাঁচ দিন কেটে গেলেও পুলিশের ভূমিকায় বিরক্ত মৃত ছাত্রের পরিবারের সদস্যরা। বুধবার হরিদেবপুর থানার সামনে অনিরুদ্ধের কাকা অভিজিৎ বিশ্বাস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘ঘটনার দিন থানায় এলেও পুলিশ অভিযোগ নিতে চায়নি। থানায় গেলে আমাদের বক্তব্যকে আমল দেওয়া হয়নি।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘এক জনকে মিথ্যাচুরির অপবাদে মারধর করা হলেও অপরাধীদের ডেকে প্রথমে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমাদের বক্তব্য, অনিরুদ্ধ মারা যাওয়ার পর বুধবার সকালে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হল। ঘটনার প্রথমেই কেন তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। কেনই বা এক জনকে (চিন্ময় সর্দার) ডেকে ছেড়ে দেওয়া হল?’’
আমচুরির অপবাদে ছাত্রকে পিটিয়ে মারার অভিযোগে শ্রীঘরে যাওয়া চিন্ময় সর্দারের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল তালা ঝুলছে। তার বাড়িতে এ দিন কোনও আমগাছ চোখে পড়েনি। চিন্ময়ের প্রতিবেশী কাকলি অধিকারী বলেন, ‘‘শুক্রবার এই ধরনের ঘটনা তাদের জানা নেই।’’ আর এক ধৃত বিনোদ বাল্মিকীর বাড়িতে ছিলেন বৃদ্ধা মা। তিনি কোনও কথা বলতে চাননি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চিন্ময় ইএসআই-এ কর্মরত ও বিনোদ একটি ওষুধের দোকানে কাজ করেন।