Advertisement
০৬ মে ২০২৪
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়

বিধি উড়িয়ে অফিসারের গদিতে ছাত্রনেতা

নিয়োগ-বিধি অনুযায়ী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিকেশন অফিসার হতে হলে ন্যূনতম বয়স ৩০ বছর হতেই হবে। তার থেকে বছর পাঁচেক কম বয়সেই তিনি ওই পদে বসেছেন। এবং স্রেফ ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র নিরিখেই তাঁর চাকরি হয়েছে বলে দাবি খোদ প্রার্থীর। কিন্তু তিনি নিজেই জানেন না, কী সেই অতিরিক্ত বিশেষ যোগ্যতা! বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছেও এর সুস্পষ্ট উত্তর নেই।

সন্তু ঘোষ

সন্তু ঘোষ

সুপ্রিয় তরফদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:২২
Share: Save:

নিয়োগ-বিধি অনুযায়ী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিকেশন অফিসার হতে হলে ন্যূনতম বয়স ৩০ বছর হতেই হবে। তার থেকে বছর পাঁচেক কম বয়সেই তিনি ওই পদে বসেছেন। এবং স্রেফ ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র নিরিখেই তাঁর চাকরি হয়েছে বলে দাবি খোদ প্রার্থীর। কিন্তু তিনি নিজেই জানেন না, কী সেই অতিরিক্ত বিশেষ যোগ্যতা! বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছেও এর সুস্পষ্ট উত্তর নেই।

ওই প্রার্থী শাসক দলের দাপুটে ছাত্রনেতা বলেই কি তাঁর নিয়োগে এই ধোঁয়াশা? প্রশ্ন উঠেছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরেই।

ওই বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিকেশন অফিসারের পদে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তার ভিত্তিতে আবেদন করেন ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদে সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকা তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বা টিএমসিপি-র নেতা সন্তু ঘোষ। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতিও তিনিই। অভিযোগ, বয়স নির্ধারিত ন্যূনতম বযঃসীমার থেকে পাঁচ বছর কম হলেও নিছক অতিরিক্ত যোগ্যতার ভিত্তিতেই তাঁকে ওই পদে নিয়োগ করা হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকেরাও।

নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে দু’ধরনের যোগ্যতার কথা বলা হয়েছিল। প্রথমটি ‘আবশ্যিক’, পরেরটি ‘কাম্য যোগ্যতা’। কাম্য যোগ্যতা হিসেবে সেখানে উল্লেখ ছিল সাংবাদিকতায় ডিগ্রি অথবা ডিপ্লোমা। এর কোনওটিই নেই সন্তুর। আবশ্যিকের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়ঃসীমা ৩০ বছর। কিন্তু মাধ্যমিকের শংসাপত্র অনুযায়ী তাঁর বয়স পঁচিশেরও কম। তা হলে তাঁকে নিয়োগ করা হল কী ভাবে?

সন্তুর নিজস্ব একটা উত্তর আছে। এ দিন ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘বয়ঃসীমার পাশেই লেখা রয়েছে, অতিরিক্ত যোগ্যতা থাকলে বয়সে ছাড় দেওয়া যায়। আমার অতিরিক্ত যোগ্যতা থাকায় আমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে।’’

সেই অতিরিক্ত যোগ্যতাটা কী?

‘‘সেটা আমি কী করে বলব? যাঁরা ইন্টারভিউ নিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কোনও সম্ভাবনা দেখেছেন। ভাল বুঝেছেন। তাই আমাকে নিয়েছেন,’’ জবাব সন্তুর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ব্যাখ্যা দিলেন, অতিরিক্ত যোগ্যতার অর্থ অন্য কোনও বিষয়ে পারদর্শিতা, অন্য কোনও বিষয়ে ডিগ্রি। ‘‘সন্তুর তো এর কোনওটাই নেই। তা হলে কোন কৃতিত্বটাকে ওর অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হল,’’ প্রশ্ন তুলেছেন ওই শিক্ষকও।

প্রশ্ন উঠেছে, সন্তু নিজেই যদি না-জেনে থাকেন তাঁর কী অতিরিক্ত যোগ্যতা রয়েছে, তা হলে কীসের ভিত্তিতে তিনি আবেদন করেছিলেন? তিনি কি আগে থেকেই জানতেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর অতিরিক্ত যোগ্যতার ফিরিস্তি রাখা আছে? সেই জন্যই কি নিজের বয়স নির্ধারিত ন্যূনতম বয়ঃসীমার থেকে পাঁচ বছর কম হওয়া সত্ত্বেও তিনি আবেদন করেছিলেন?

‘‘আমরা সকলেই স্বাধীন। সকলেরই আবেদন করার অধিকার আছে। তাই আমিও প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেছি,’’ জবাব সন্তুর।

এই ব্যাপারে সন্তুর পাশে দাঁড়িয়েছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দেবকুমার পাঁজা। তিনি বলেন, ‘‘বয়স কিছুটা কম হলেও অতিরিক্ত যোগ্যতার জন্যই সন্তুকে নিয়োগ করা হয়েছে।’’

ওঁর অতিরিক্ত যোগ্যতাটা কী?

দেবকুমারবাবুর জবাব, ‘‘যাঁরা ওর নিয়োগের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন, তাঁদেরই বলতে বলুন।’’

কী বলছেন উপাচার্য?

সিলেকশন বা নির্বাচন কমিটির উপরে যাবতীয় দায় চাপিয়ে দিয়েছেন উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার। সন্তুর নিয়োগের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। সিলেকশন কমিটি তাঁর নাম বেছে নিয়েছে। কর্মসমিতিতেও ওই নাম ঠিক হয়েছে। এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারব না।’’

কিন্তু উপাচার্য যে-সিলেকশন কমিটির কথা বলছেন, তিনি নিজেই তো তার চেয়ারম্যান। সে-ক্ষেত্রে তাঁরই জবাব দেওয়ার কথা নয় কি?

‘‘আমার আর কিছু বলার নেই,’’ সাফ জানিয়ে দেন উপাচার্য।

অনেক ঢুঁড়েও যখন ওই প্রার্থীর অতিরিক্ত যোগ্যতার খোঁজ মিলল না, তখনই কানে এল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরের একটি গুঞ্জন। সেই গুঞ্জন বলছে, সন্তু বর্ধমানের মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের ভারপ্রাপ্ত)-এর স্নেহভাজন এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি অশোক রুদ্রের ঘনিষ্ঠ। এবং সেই সুবাদেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ। সন্তু নিজে অবশ্য বলছেন, ‘‘এই অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। এ বার তো দেখছি, কোনও চাকরি হলেই দলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কথা উঠবে!’’

স্নেহ দূরের কথা, সন্তুর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কথাও অস্বীকার করেছেন মন্ত্রী রবিরঞ্জনবাবু। তিনি বলেন, ‘‘আমি সন্তু নামের কাউকে চিনিই না। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও বিষয়েই আমি নাক গলাই না। কার নিয়োগ কী ভাবে হয়েছে, সেই সব বিষয় আমার জানার কথাও নয়।’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিকেশন অফিসার-পদে সন্তুর নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর কোনও হাত নেই বলে জানিয়েছেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্রও। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল ছাত্র পরিষদে আমার অনুগামী বলে কেউ নেই। সকলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে দল করে। যেখানেই নিয়োগ হবে, যোগ্যতা মেনেই হবে। তার সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পর্ক নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Student leader Education officer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE