স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে মাঝেমধ্যেই বলত, পিঠে আর শিরদাঁড়ায় অসহ্য যন্ত্রণার কথা। খেলাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ক্যালকাটা গার্লস স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী দেবলীনা বসুর (নাম পরিবর্তিত)। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, পিঠে ভারী স্কুলব্যাগ নেওয়ার প্রভাব মেরুদণ্ডেও পড়তে শুরু করেছে। বেশি দিন এমন চললে মেরুদণ্ডের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে!
স্কুলব্যাগের বোঝা কমাতে কেন্দ্রীয় আইন হয়েছে ২০০৬ সালে। তাতে বলা হয়েছে, পড়ুয়াদের ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি হবে না। স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, এ রাজ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও ব্যাগের ওজন কমানোয় গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। দফতরের মতে, ব্যাগের ওজন চতুর্থ শ্রেণিতে ৩ কেজির কম, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৪ কেজির কম এবং অষ্টম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ সাড়ে চার কেজি হওয়া উচিত। কিন্তু শহরের ছবি বিশেষ বদলায়নি বলেই অভিযোগ।
সম্প্রতি এক দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ লা-মার্টিনিয়ার স্কুলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, প্রাক্-প্রাথমিকের খুদেদের কাঁধে স্কুলের নাম লেখা ব্যাগ। ব্যাগে রয়েছে বই, খাতা, টিফিন ও জলের বোতল। সব মিলিয়ে ব্যাগের ওজন পাঁচ কেজির আশপাশে। স্কুল থেকে বার হতেই ওই পড়ুয়ার দাদু নিজের কাঁধে তুলে নিলেন ব্যাগটি। তাঁর যুক্তি, ‘‘ব্যাগটা যে কাপড়ের তৈরি, সেটাই বেশ ভারী। বাচ্চা কী ভাবে নেবে? তাই আমি নিয়েছি।’’
২০০৬ সালের কেন্দ্রীয় আইন
• পড়ুয়াদের ব্যাগের ওজন শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি নয় • নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেনের পড়ুয়াদের স্কুলব্যাগ নয় • স্কুলে পড়ুয়াদের লকার
স্কুলব্যাগে কী কী থাকে?
• অন্তত ৭-৮টি পাঠ্যবই। অনেক সময়ে একাধিক রেফারেন্স বই • প্রতিটি বিষয়ের একটি বা দু’টি বোর্ড কভারের খাতা • পেনের বাক্স • দু’টি টিফিন বাক্স • জলের বোতল • ছাতা বা বর্ষাতি • ক্যারাটে বা পিটি-র ক্লাস থাকলে আলাদা পোশাক
তবে লা-মার্টিনিয়ারের সচিব সুপ্রিয় ধর বলেন, ‘‘বিভিন্ন ক্লাসে লকার রয়েছে। পড়ুয়ারা চাইলেই সেখানে বইখাতা রেখে যেতে পারে। তা ছাড়া অভিভাবকেরা প্রয়োজনের থেকেও বেশি বই ব্যাগে দেন। ভারী স্কুলব্যাগ দেওয়া মানে তো শাস্তি দেওয়া। স্কুল সেটা কোনও দিন করেনি, করবেও না।’’
ওই দিন ক্যালকাটা গার্লসের সামনে গিয়ে দেখা গেল, পড়ুয়াদের পিঠে ও হাতে দু’-দু’টি ব্যাগ! কেন? এক পড়ুয়ার উত্তর, ‘‘এক ব্যাগে সমস্ত বইখাতা ধরে না। তাই আর একটা ব্যাগ নিতে হয়। এতে কাঁধের উপর চাপও কিছুটা কমে।’’
আরও পড়ুন: সোনার ছেলে সৌরভ এখনও চাষে যায় বাবার সঙ্গে
ব্যাগ দু’টির ওজন কত? স্কুলের কাছে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে ওজন করা হল। ইলেক্ট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ডে ফুটে উঠল, ৯ কেজি ৪০০ গ্রাম। দেখে আঁতকে উঠলেন ছাত্রীর মা।
বড্ড ভারী: এক স্কুলের সামনে ব্যাগের ওজন দেখে অবাক ছাত্রী। —নিজস্ব চিত্র।
তাঁর কথায়, ‘‘অভিভাবকদের একটি ফোরামের মাধ্যমে স্কুলকে এই সমস্যার কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনও সমাধান হয়নি। অনেকেরই পিঠে ব্যথা শুরু হয়েছে।’’
ব্যাগ কেন এত ভারী? অভিভাবকেরা জানান, আইসিএসই, সিবিএসই বোর্ডের বইগুলো বড়। বইয়ের পাতা বেশ মোটা। ফলে বইয়ের ওজন বেশি। তার সঙ্গে বোর্ডের কভার দেওয়া দামি খাতা, টিফিনবক্স ও জলের বোতল, স্কুল থেকে দেওয়া ডায়েরি।
তবে স্কুলের প্রিন্সিপাল বাসন্তী বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে স্কুলে খাতা নিয়ে আসতে হবে না। পরিবর্তে ফাইল ও লেখার কাগজ নিয়ে এলেই হবে। তবে তা কোন ক্লাস থেকে চালু হবে, এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।’’
পার্ক সার্কাসের কাছে ডন বস্কো এবং মহাদেবী বিড়লা ওয়র্ল্ড অ্যাকাডেমিতেও ভারী ব্যাগের অভিযোগ পড়ুয়াদের। সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র জানাল, সে ফাস্ট বোলিং করে। এখন কাঁধের ব্যথায় ভাল বোলিং করতে পারছে না। চিকিৎসক তাকে জানিয়েছেন, ভারী ব্যাগ নেওয়া বন্ধ না করলে ব্যথা বাড়বে। ভারী ব্যাগ নিয়ে ওপরে উঠতে কষ্ট হয় বলে জানাচ্ছে মহাদেবী বিড়লার এক পড়ুয়াও। সাউথ পয়েন্ট বা বাংলা মাধ্যমের হিন্দু, হেয়ার এবং যাদবপুর বিদ্যাপীঠের মতো স্কুলেও একই অভিযোগ। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের মুখপাত্র কৃষ্ণ দামানি বলেন, ‘‘প্রয়োজনের একটিও বেশি বই পড়ুয়ারা যেন না আনে, তা আগেও বলা হয়েছিল। ফের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।’’ যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের বয়সের তুলনায় ব্যাগ কিছুটা ভারী। তবে আগের থেকে অনেক কমেছে। স্কুলশিক্ষা দফতর যা নির্দেশ দেবে, সে ভাবেই কাজ করব।’’
তবে হেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুনীল দাসের কথায়, ‘‘সরকারি স্কুলে ব্যাগের ওজন বেশি হয় না। কিন্তু বেশ কয়েক জন অভিভাবকই বলেন, সরকারি স্কুলে বই কেন কম? আরও কয়েকটা বই দেওয়া যেতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy