Advertisement
E-Paper

ধুম জ্বরে কাতরাচ্ছে প্রিয়দা, আমি কাঁদছি

সেই ৬০-এর দশকে গ্রাম থেকে কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে পড়তে এলাম। একটু-আধটু ছাত্র পরিষদ করি, কিন্তু প্রিয়দাকে তখনও জানতাম না। এনসিসি-তে আমি ছিলাম নেভির ক্যাডেট ক্যাপ্টেন। প্রিয়দা তখন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।

সুব্রত মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:৪৫
—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

নেতা ব্যাপারটা একটা কনসেপ্ট। যা মনের মধ্যে তৈরি হয়। চাপিয়ে দিলেই সব সময় তা মেলে না। ধারণার সঙ্গে বাস্তবের ফারাকটা খচখচ করে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। প্রিয়দাকে নেতা মানার ক্ষেত্রে আমার মনে কোনও কাঁটা নেই। কারণ, সে আমার দাদা, বন্ধু, খেলা দেখা-সিনেমা দেখার সঙ্গী। তার লন্ড্রিতে কাচানো ধুতি পরে আমার প্রেম করা। আমাদের এক ধোপা, এক নাপিত, এক ডাক্তার। প্রিয়দা শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত এমনটাই ছিল।

সেই ৬০-এর দশকে গ্রাম থেকে কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে পড়তে এলাম। একটু-আধটু ছাত্র পরিষদ করি, কিন্তু প্রিয়দাকে তখনও জানতাম না। এনসিসি-তে আমি ছিলাম নেভির ক্যাডেট ক্যাপ্টেন। প্রিয়দা তখন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ও ছিল এনসিসি-র স্থলবাহিনীর অফিসার। ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার জন্য ফোর্ট উইলিয়ামে বেস্ট ক্যাডেট ক্যাম্প হল। সেখানে প্রথম আলাপ। এক সঙ্গে থাকা, লাইন দিয়ে খাবার নেওয়া, প্যারেড করা সব মিলিয়ে কেমন একটা যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেল। প্রিয়দা সেই সময়ে বাম-বিরোধী ছাত্র ইউনিয়ন ইউএসও-র কোষাধ্যক্ষ।

আরও পড়ুন: ‘আজ আবার আমার পিতৃবিয়োগ হল’

অল্প দিন পরেই রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন। প্রিয়দার ডাকে ইউনিফর্ম পরে ভলান্টিয়ারি করতে গেলাম। আর ফেরা হল না। প্রিয়দার সঙ্গেই থেকে গেলাম। বিএ পরীক্ষায় অনার্স মিস করে মডার্ন হিস্ট্রি নিয়ে এম এ-তে ভর্তি হতে পারলাম না। প্রিয়দার পরামর্শে ভাইভা দিয়ে আর্কিওলজিতে ভর্তি হলাম। ঘনিষ্ঠতা আরও নিবিড় হওয়ার সেই শুরু। প্রিয়দা উঠলে ওঠা, বসলে বসা। প্রিয়দার নির্দেশ মেনে ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে কংগ্রেস ও ছাত্র পরিষদের হয়ে বক্তৃতা করতে হত। তখন তো কংগ্রেসের দুঃসময়। ছাত্র পরিষদের নামে ছাত্রছাত্রীরা কুকুর, বিড়াল, ব্যাঙ ডাকত। লজ্জা, সংকোচ, ভয়ে বক্তৃতা না করে পালিয়ে বেড়াতাম। বিকেলে প্রিয়দা ধরে ফেলত, ‘‘কী রে, তোর না আজ ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল, গিয়েছিলি?’’ যাইনি শুনে বকুনি। তার নির্দেশ ছিল: কে শুনল, না শুনল সেটা বড় কথা নয়। রোজ প্রচারে যেতেই হবে। সেটা আমাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব। এ ভাবেই সংগঠন গড়তে হয়।

রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রিয়দার এই একনিষ্ঠতা আমি বরাবর দেখেছি। রাজনীতির মধ্যে থাকাই ছিল প্রিয়দার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, অন্য আর কোনও কিছুতে সে এমন স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য পেত না। প্রিয়দার নেতৃত্বের একটা বড় গুণ হল, শূন্য থেকে গড়ে তোলার ক্ষমতা। আমি তো বলি, একটা ফাঁকা ঘরে প্রিয়দাকে ঢুকিয়ে দিলে দু’দিনেই ও পুরো অফিস বানিয়ে দেবে।

প্রথমে হার্ডিঞ্জ হস্টেলে তার পর মহাজাতি সদনের একটি ঘরে আমরা এক সঙ্গে থাকতাম। রাতে ঘরে ফিরে একটি ইকমিক কুকারে সেদ্ধ ভাত রাঁধত প্রিয়দা। আমি ঘুমোতাম। ডেকে তুলে খাওয়াত। এক দিন নয়, দিনের পর দিন। ওখানেই একবার প্রিয়দার পক্স হল। ধুম জ্বরে, যন্ত্রণায় প্রিয়দা কাতরাচ্ছে, আমি ভয়ে কেঁদে ফেলেছি। পরের দিন কালীঘাটে প্রিয়দার এক মামার বাড়ি তাকে পৌঁছে দিয়ে এলাম। সেরে উঠে আবার মহাজাতি সদনে।

প্রিয়দার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে দু’বার। প্রথম, যখন প্রিয়দা ইন্দিরাজিকে ছেড়ে কংগ্রেস (স) তৈরি করে। দ্বিতীয়বার, যখন আমি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিই। প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমি প্রিয়দার নেতৃত্বে চিরদিন আস্থা রেখেও আমি কেন কংগ্রেস (স)-তে যাইনি? প্রিয়দা কংগ্রেস ছেড়েছিল সঞ্জয় গাঁধীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার কারণে। সঞ্জয় গাঁধীর উত্থান এবং জরুরি অবস্থার সময়ে বাড়াবাড়ি প্রিয়দা মানতে পারেনি। আমিও যে ব্যক্তিগত ভাবে সঞ্জয়-সমর্থক ছিলাম তা নয়। এ নিয়ে দিনের পর দিন প্রিয়দার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আজ বলি, স্রেফ ইন্দিরা গাঁধীর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম বলেই সে দিন স্বাভাবিক ভাবে ইন্দিরাজিকে বেছে নিয়েছিলাম। রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তিগত আবেগটাই কাজ করেছিল বেশি। প্রিয়দার বাড়িতে বসে আমরা দু’জনেই তখন কাঁদতাম। সত্যিকারের রাজনৈতিক মতভেদ থাকলে বোধ হয় এটা হতো না। ইতিহাস সে সব দিনের সাক্ষী। তাই, আমার কংগ্রেস (স)-তে না যাওয়াকে আমি ঠিক প্রিয়দার সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব বলে মানতে রাজি নই।

আর আমার তৃণমূলে যাওয়া? সেটাকেও আমি কংগ্রেসের ঘর ছাড়া আলাদা কিছু ভাবিনি। তাই, প্রিয়দা কংগ্রেস, আমি তৃণমূল এটাও আমাদের মধ্যে কোনও বিভেদ বলে আমি মনেই করিনি। বাড়িতে আসা-যাওয়া তো দূরের কথা, আমি মেয়র থাকাকালীন প্রিয়দা পুরসভায় আমার ঘরে এসেছে একেবারেই ব্যক্তিগত আড্ডা মারতে। আমিও সময়ে সময়ে পরামর্শ নিয়েছি প্রিয়দার কাছে।

ইন্দিরাজি চেয়েছিলেন আমি রাজ্যে থাকি এবং প্রিয়দা দিল্লিতে রাজনীতি করুক। সে ভাবেই ১৯৭১-এ আমি বিধায়ক, প্রিয়দা সাংসদ। ’৭২-এ প্রিয়দাই আমাকে জোর করে মন্ত্রিসভায় পাঠায়। মন্ত্রী থাকাকালীন আমার বিয়ে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই তাই প্রচার মাধ্যমের কিছুটা বাড়তি নজর ছিল মন্ত্রীর বিয়েতে কী হয় না হয়, তার দিকে। প্রিয়দা সতর্ক ছিল, যাতে এমন কোনও বাহুল্য না হয়ে যায় যে, সেটা মুখরোচক খবর হয়ে ওঠে। আমার বিয়ের ভোজের মেনুও প্রিয়দার পরামর্শে তৈরি হয়। প্রিয়দা অবশ্য বিয়ে করে অনেক দেরি করে। বলত, ওর নাকি মনের মতো মেয়ে মিলছে না। মাঝে মাঝেই ঠাট্টা হতো। আমি বলতাম, তুমি বরং কুমোরটুলিতে অর্ডার দিয়ে বউ বানিয়ে নিয়ে এসো। নইলে আর তোমার এ জীবনে বিয়ে করা হবে না।

এ কথা ঠিক, অতি উৎসাহে বা অনেককে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রিয়দা হঠাৎ এমন অনেক কিছু করে ফেলত, যাতে ‘সদা সত্য কথা’ বলার নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে বারবার। তবে, সহকর্মীদের প্রতি প্রিয়দার যে দরদ ও মমত্ববোধ আমি দেখেছি সেটাও মনে রাখার মতো। আমার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ প্রিয়দার মতো কেউ বুঝত না। আমার রাগ হয়েছে বুঝলে প্রিয়দা আমার বাড়ি চলে আসত। একবার সিঙ্গুরে মমতার সভায় আমার যাওয়া নিয়ে বিতর্ক হল। আমি বারো পাতার জবাব লিখে রেডি। প্রিয়দা এসে বলল, ‘‘কী এত লিখেছিস! দু’লাইনের একটা চিঠি দিয়ে দে। বাকি আমি দেখব।’’

বলতে গেলে এত কথা ভিড় করে আসছে, যে এ লেখা শেষ হবে না। তাই, সংক্ষেপে এটুকু বলে শেষ করি যে, কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীদের নাড়ি বোঝার মতো কোনও নেতা এ রাজ্যে আজও প্রিয়দার পরে আর কেউ এলেন না। তাই, প্রিয়দা ক্ষমতায় থাক বা না থাক কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত সর্বত্র রয়েছে প্রিয়দার নিজস্ব সমর্থক গোষ্ঠী। গোষ্ঠী রাজনীতিতে অভ্যস্ত কংগ্রেসে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির এ এক বড় সাফল্য। এ শূন্যতা পূরণ হওয়া তাই বেশ কঠিন।

Priya Ranjan Dasmunsi Subrata Mukherjee সুব্রত মুখোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy