Advertisement
০১ মে ২০২৪

জানতাম মা ঠিক ফিরবে, সুনীতাকে পেয়ে বলল আর্য

এ যাত্রা মরা যে হচ্ছে না, আগেই বুঝে গিয়েছিলেন ৪২ বছরের সুনীতা হাজরা। আট হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতা থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে নেমেছিলেন সমতলে। ঘরে ফিরতে লেগে গেল আরও ক’টা দিন।

ছেলে আর্যবীরকে দেখেই বাঁধ ভেঙেছে আবেগ। এভারেস্ট ছুঁয়ে কলকাতা ফেরার পর সুনীতা হাজরা। শনিবার কলকাতা বিমানবন্দরে শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

ছেলে আর্যবীরকে দেখেই বাঁধ ভেঙেছে আবেগ। এভারেস্ট ছুঁয়ে কলকাতা ফেরার পর সুনীতা হাজরা। শনিবার কলকাতা বিমানবন্দরে শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০৩:৩৬
Share: Save:

এ যাত্রা মরা যে হচ্ছে না, আগেই বুঝে গিয়েছিলেন ৪২ বছরের সুনীতা হাজরা। আট হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতা থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে নেমেছিলেন সমতলে। ঘরে ফিরতে লেগে গেল আরও ক’টা দিন।

শনি-বিকেলে কাঠমান্ডুর উড়ান কলকাতা বিমানবন্দরের মাটি ছোঁয়ার পরে তাই একটি বার ছেলেকে দেখার জন্য যেন তর সইছিল না মায়ের। হুইলচেয়ারে করে পুত্রের কাছে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অবধি কোনও রকমে আবেগ চেপে রেখেছিলেন প্রথম বাঙালি মা হিসেবে দুনিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বিজয়িনী। ছেলে আর্যবীরকে দেখামাত্রই সব বাঁধ ভেঙে গেল।

মা আসার আগেই বেশ অনেক ক্ষণ সংবাদমাধ্যমের লাইট-ক্যামেরা সামলেছে খুদে আর্য। ‘‘মায়ের জন্য চিন্তা হচ্ছিল?’’ জাতীয় প্রশ্নের প্রতিটা বাউন্সারে একই রকম দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যাট চালিয়েছে, ‘‘কোনও চিন্তা হয়নি আমার। মা পাহাড়ে গেলে আমার ভাল লাগে।’’

বারাসতের বাড়িতে ফেরার পরে কোনও মতে কথা বলছিলেন সুনীতা। ‘‘পাহাড়ে সব আশা ফুরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও ছেলের মুখটা ভাবছিলাম। সেটাই শক্তি জোগাচ্ছিল। পায়ে-পায়ে নামছিলাম তুষার ঝড়ের মধ্যে। ওকে দেখার মুহূর্তটা তাই কান্না সামলাতে পারিনি।’’ সুনীতা কথাগুলো বলার সময়ে সারা ক্ষণ মাকে আঁকড়ে রইল ক্লাস সিক্সের আর্য।

তবে মা ভেঙে পড়লেও ছেলে কিন্তু সাহস হারায়নি। সেই প্রথম দিন থেকেই। খোঁজ না-মেলার খবর পেয়ে যখন সবাই দুশ্চিন্তায় পাগল, একমাত্র আর্যই গম্ভীর মুখে বলেছিল, ‘‘ঠিক খবর পাওয়া যাবে।’’ এ দিনও বলল তাই-ই। ‘‘আমি জানতাম, মা ঠিক নামতে পারবে। মায়ের লড়াইয়ের উপরে আমার পুরো ভরসা আছে।’’ — মাকে জড়িয়ে ধরে বলল আর্য। তখন সুনীতার পরিজনেরা আলোচনা করছেন, এইটুকু ছেলেকেই তো মায়ের অভিভাবক মনে হচ্ছে!

আর্যর মনের জোরের কথা শোনা যাচ্ছিল বারাসতের নোয়াপাড়ার বাড়িতে সুনীতার প্রতিবেশীদের কাছেও। সুনীতা ও তাঁর স্বামী সুদেবের পারিবারিক বন্ধু অমিত ও মাধবী সরকার সুনীতার বাড়িতেই ছিলেন। মাধবী বারবার বলছিলেন, খুদে আর্যর সাহসের কথা। তাঁর কথায়, ‘‘সুনীর খবর না-পেয়ে আমি তো কেঁদে অস্থির! কিন্তু ওইটুকু ছেলে আমায় বোঝাচ্ছিল, আন্টি তুমি কেঁদো না, মায়ের কিছু হয়নি। টিভি-তে ওরা বলেছে, মা ‘মিসিং’। ‘মিসিং’ মানেই তো ‘এন্ড’ নয়। ধৈর্য ধরো। আমি বলছি, মা ঠিক ফিরে আসবে।’’

শনিবার দুপুর থেকে দেড় দিন সুনীতার কোন খবরই ছিল না পরিবারের কাছে। উৎকণ্ঠার ওই প্রহরে মন্দিরে মানত থেকে শুরু করে ঘরের মেয়ের ফিরে আসার কামনায় কোনও চেষ্টাই বাদ রাখেননি প্রিয়জনেরা। সুনীতার শাশুড়ি বিনোদদেবী দু’টো দিন কোনও খাবার দাঁতে কাটতে পারেননি। রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারছিলেন না কেউ।

সুনীতার স্বামী সুদেব রবিবারই কাঠমান্ডু চলে গিয়েছিলেন। উদ্ধার হওয়ার পরে ক্যাম্প টু থেকে লুকলায় নেমে ‘সুনী’ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন, সোমবার বিকেলে। কাঠমান্ডুর হাসপাতালে চিকিৎসার পরে খানিকটা সুস্থ হয়ে কলকতায় ফিরতে আরও দিন পাঁচেক লেগে গেল। এ দিন সন্ধ্যায় বা়ড়ি ফেরার পরে বিমানযাত্রার ধকলে বেশ ক্লান্ত লাগছিল সুনীতাকে। বান্ধবী লিপিকা বিশ্বাস এসে খানিকটা জল-মুড়ি খাইয়ে দিলেন বিজয়িনীকে।

তবে রাতটা সুনীতাকে বাড়িতে রাখার ঝুঁকি নেননি পরিজনেরা। সন্ধ্যায় তাঁকে কলকাতার ডানলপের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। এখন দুশ্চিন্তা ডান হাতের ফ্রস্ট বাইট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mountaineer Sunita hazra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE