Advertisement
E-Paper

ধরা দিয়েই জামিন বিধায়কের

দেড় মাস ধরে তিনি অসুস্থ হয়ে সোনামুখীর বাড়িতেই ছিলেন। অথচ তাঁকে খুঁজে পায়নি পুলিশ! সোমবার সাতসকালে এসে ধরা দিলেন বিষ্ণুপুরের এসিজেএম আদালতে। কোনও সরকারি আইনজীবীই হাজির ছিলেন না তাঁর জামিনের প্রতিবাদ করতে! তাই জামিন-অযোগ্য ধারা থাকা সত্ত্বেও ছাড় পেয়ে গেলেন সহজেই। তাঁর হয়ে লড়লেন রাজ্যেরই মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়!

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৪ ০৪:৪৮
জামিন পাওয়ার পর বিষ্ণুপুর আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন দীপালি সাহা। ছবি: শুভ্র মিত্র।

জামিন পাওয়ার পর বিষ্ণুপুর আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন দীপালি সাহা। ছবি: শুভ্র মিত্র।

দেড় মাস ধরে তিনি অসুস্থ হয়ে সোনামুখীর বাড়িতেই ছিলেন। অথচ তাঁকে খুঁজে পায়নি পুলিশ! সোমবার সাতসকালে এসে ধরা দিলেন বিষ্ণুপুরের এসিজেএম আদালতে। কোনও সরকারি আইনজীবীই হাজির ছিলেন না তাঁর জামিনের প্রতিবাদ করতে! তাই জামিন-অযোগ্য ধারা থাকা সত্ত্বেও ছাড় পেয়ে গেলেন সহজেই। তাঁর হয়ে লড়লেন রাজ্যেরই মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়!

সোমবার এই ভাবে যিনি এলেন, ধরা দিলেন এবং জামিন নিয়ে গটগট করে আদালত ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, তিনি দীপালি সাহা। বাঁকুড়ার সোনামুখীর তৃণমূল বিধায়ক। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, গত ৭ মে চতুর্থ দফার লোকসভা ভোটের দিন সোনামুখীর সাহাপুরের ২৭ নম্বর বুথে দলবল নিয়ে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসার-সহ ভোটকর্মীদের মারধর করে আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ছাপ্পা ভোট করানো। নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত যে ফটোগ্রাফার ওই বুথে ভোট প্রক্রিয়ার ছবি তুলছিলেন, তাঁকেও মারধর করে ভিডিও ক্যামেরাটি ছুড়ে ফেলা হয় বলে অভিযোগ।

ঘটনার দিনই বিধায়ক ও তাঁর কিছু অনুগামীর বিরুদ্ধে সোনামুখী থানায় এফআইআর করেন প্রিসাইডিং অফিসার সুখেন্দু রজক। বিধায়কের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে পুলিশ। তার পর ছাপ্পা ভোটে জড়িত সন্দেহে সাহাপুর থেকে ১০ জনকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু দীপালিদেবীকে ধরতে পারেনি পুলিশ। উল্টে টানা দেড় মাস বাঁকুড়া জেলা পুলিশ দাবি করেছে, বিধায়ককে পাওয়াই যাচ্ছে না।

অথচ এ দিন দলের এই বিধায়কের হয়ে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদবাবু দাবি করলেন, “উনি তো বাড়িতেই ছিলেন। অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসা চলছিল।” বিচার শেষে আদালত থেকে বেরনোর পরে সাংবাদিকরা দীপালিদেবীর কাছে জানতে চান, এত দিন কোথায় ছিলেন? জবাব দেননি দীপালিদেবী। তাঁর হয়ে শ্যামবাবুই এ কথা বলেন।

দীপালিদেবীকে এত দিন কেন ধরা গেল না, সে প্রশ্নের উত্তর যাঁর কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব, বাঁকুড়ার সেই পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার সোমবার দিনভর ফোন ধরেননি। তাঁর মোবাইলে বার ছয়েক এসএমএস করা হলেও কোনও জবাব আসেনি।

দেড় মাস ‘ফেরার’ থাকা বিধায়ক এ দিন সকাল সাতটায় নিঃশব্দে গাড়ি নিয়ে হাজির হন এসিজেএম পবিত্রকুমার সেনের এজলাসে। দর্শকাসনের পিছনের দিকে গিয়ে বসেন। কথা বলেন নিজের আইনজীবীদের সঙ্গেও। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আদালত চত্বর কার্যত তৃণমূলের দখলে চলে যায়। সাড়ে ৮টায় আসেন তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি বিষ্ণুপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হলেও দীর্ঘ কয়েক বছর তাঁকে সওয়াল করতে আদালতে দেখা যায়নি। তাই, আদালতের আইনজীবী ও কর্মীদের অনেকেই তাঁকে কালো কোটে দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি এজলাসে ঢুকেই দীপালিদেবীর আইনজীবীদের সঙ্গে এক প্রস্ত আলোচনা সেরে নেন।

ন’টা নাগাদ এজলাসে আসেন এসিজেএম। শ্যামবাবু বিচারকের কাছে আর্জি জানান, দীপালিদেবী এক জন বিধায়ক। বিধানসভা যাওয়ার জন্য তাঁর জামিন পাওয়া জরুরি। তিনি সেখানে উপস্থিত না হতে পারলে এলাকার দু’লক্ষ মানুষ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হবেন। দুই সরকারি আইনজীবীর কেউই এ দিন আদালতে না থাকায় জামিনের বিরোধিতাও হয়নি। বিচারকই জানতে চান, দীপালিদেবী এত দিন বাদে আত্মসমর্পণ করছেন কেন? শ্যামবাবু জানান, উনি অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই ছিলেন। চিকিৎসা চলছিল। বিচারকের পরের প্রশ্ন, বিধায়কের দু’জন দেহরক্ষী থাকার কথা। তা সত্ত্বেও পুলিশ জানতে পারল না কেন, উনি কোথায় রয়েছেন? শ্যামবাবু বলেন, “তদন্তে পুলিশ মনে করেনি বলেই হয়তো গ্রেফতার করেনি।” এত দিন বিরোধীরা পুলিশের বিরুদ্ধে হাত গুটিয়ে থাকার যে অভিযোগ তুলছিলেন, এ দিন মন্ত্রীর কথাতেও সে কথার সমর্থন মিলেছে।

এই সওয়াল-জবাবের পরে বিচারক জানান, দীপালিদেবী জনপ্রতিনিধি হলেও এ রকম একটি ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছেন। তবে, বিধানসভাতেও তাঁর যাওয়া প্রয়োজন বলে জামিনের আবেদন মঞ্জুর করা হল। তাঁর নির্দেশ, তদন্ত চলাকালীন দীপালিদেবীকে আদালতে ডাকা হলে তাঁকে হাজিরা দিতে হবে এবং তদন্তের কাজে সব রকম সাহায্য করতে হবে। বিচারক দীপালিদেবীকে পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যক্তিগত বন্ড এবং ১০ হাজার টাকা ‘রেজিস্ট্রেশন সিকিওরিটি’ বাবদ জমা দিতেও নির্দেশ দেন।

একে তো দেড় মাস ধরে দীপালিদেবীকে ‘খুঁজেই পায়নি’ পুলিশ। তার উপরে যে দিন তিনি আত্মসমর্পণ করলেন, সে দিনও তাদের কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বিরোধী রাজনীতিক এবং আইনজীবীদের একাংশ দীপালিদেবীর হয়ে শ্যামবাবুর ওকালতিতে বিস্মিত। তাঁদের যুক্তি, শ্যামবাবু রাজ্যের মন্ত্রী, সুতরাং প্রশাসনের অঙ্গ। তিনি কী ভাবে প্রশাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে মামলায় লড়াই করেন! তাঁদের দাবি, এই কাজের জন্য মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়া উচিত শ্যামবাবুর। যদিও শ্যামবাবুর যুক্তি, “আমি বিষ্ণুপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। দলের বিধায়কের জামিনের জন্য মন্ত্রী নয়, এক জন আইনজীবী হিসেবেই সওয়াল করেছি।” যদিও আইনজীবী মহলের বক্তব্য, সরকারের বেতনভুক হয়ে মন্ত্রী এমনটা করতে পারেন না। আর গরহাজিরার কারণ দেখাতে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটার বা এপিপি স্বপন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আর এক জন এপিপি যে এ দিন ছুটি নিয়েছেন, তা আমার জানা ছিল না। আমি অসুস্থতার জন্য যেতে পারিনি।” অন্য এপিপি হাসিউর রহমানের বক্তব্য, “আমি দরখাস্ত দিয়ে ছুটি নিয়েছি। স্বপনবাবুর তো তা জানার কথা।” জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, “আদালতে আমাদের তরফ থেকে কী কী করা হয়েছিল, তা আমি বাঁকুড়া জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) কাছে রিপোর্ট চাইব।” পিপি রীনা চক্রবর্তী (যিনি বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর স্ত্রী) বলেন, “ওই দু’জন সরকারি আইনজীবী কেন আসেননি বলতে পারব না। জেলাশাসক জানতে চাইলে, তদন্ত করে তাঁকে রিপোর্ট দেব।”

বিরোধীদের অভিযোগ, সবটাই আগে থেকে তৈরি করা চিত্রনাট্য ধরে এগিয়েছে। এবং হয়েছে শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বলছেন, “রায়গঞ্জে বেল, মাজদিয়ায় জেল (কলেজে অধ্যক্ষ-নিগ্রহ প্রসঙ্গে এই স্লোগানই তুলছিল সিপিএম)! আমরা বারবারই বলছি, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে! এখন হল, রায়দিঘিতে জেল, সোনামুখীতে বেল!”

দীপালির দিন

সকাল ৭টা গাড়ি চেপে বিষ্ণুপুর কোর্টে দীপালি সাহা।

৭-৩০ ভিড় ঠেকাতে কোর্টে বাড়তি পুলিশ।

৮-৩০ দীপালির হয়ে কোর্টে মন্ত্রী শ্যাম মুখোপাধ্যায়।

৯টা এজলাসে বিচারক পবিত্রকুমার সেন।

১০-৩০ দীপালির জন্য মন্ত্রীর সওয়াল। মিলল জামিন।

১১-৩০ হাসি মুখে এজলাস ছাড়লেন দীপালি।

বস্তুত, শুধু দীপালিই নন, ঊষারানি মণ্ডল, মনিরুল ইসলামের মতো বিধায়কেরা শাসকদলের বলেই তাঁদের ‘সাত খুন মাফ’ হয়ে যাচ্ছে এই অভিযোগে শুক্রবারই বিধানসভায় হইচই করেছিল বামেরা। তার আগে থেকেই চাপ বাড়ছিল দীপালির উপরে। তৃণমূল শীর্ষ মহল থেকে দীপালিদেবীকে সময় বুঝে আত্মসমর্পণ করতেও বলা হয়। অনেক দিন ধরেই তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন। গত ৯ জুন বিষ্ণুপুরে খবর রটে যায়, তিনি আত্মসমর্পণ করছেন। আদালত চত্বর ছেয়ে যায় পুলিশ ও র্যাফে। বিক্ষোভ দেখাতে চলে আসেন বিজেপি কর্মীরা। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত বিধায়ক আর আসেননি। তৃণমূলের জেলা নেতাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ওই দিন দীপালিদেবীকে পুলিশ সোনামুখী থেকে বিষ্ণুপুরে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু, আদালত চত্বরে বিক্ষোভ হতে পারে, আঁচ করে দীপালি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে চলে যান শহরেরই এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার বাড়িতে।

শ্যামবাবু যা-ই দাবি করুন, তৃণমূল সূত্রের খবর, আত্মগোপন করতে এত দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন দীপালি। স্বামী সমীর সাহার সঙ্গে মাঝে অনেক দিন তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতেও ছিলেন। প্রশাসনিক কিছু অফিসারের সঙ্গে বিধায়কের ফোনে যোগাযোগ ছিল বলেও জানা যাচ্ছে। যদিও এ ক্ষেত্রে তিনি অন্য নম্বর ব্যবহার করেছেন। কলকাতার এমএলএ হস্টেলেও একাধিকবার তাঁকে দেখা গিয়েছে বলেও খবর।

তবে আজ না হোক কাল, আত্মসমর্পণ যে করতেই হবে, সেটা দীপালি ভাল ভাবেই বুঝে গিয়েছিলেন। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কোনও উপায়ও ছিল না!” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, “অনেক আগেই ওঁর আত্মসমর্পণ করা উচিত ছিল। এক জন জনপ্রতিনিধির এই ভাবে পালিয়ে বেড়ানোটা খুবই দৃষ্টিকটু!”

প্রশ্ন উঠেছে, এখন বিভিন্ন ঘটনায় অভিযুক্ত তৃণমূলের অন্য নেতা-বিধায়কেরা তা হলে কী করবেন? দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের বক্তব্য, “আইন যা নির্দেশ দেবে, সেই মতো পদক্ষেপ করা হবে।”

swapan bandyopadhyay dipali saha sonamukhi tmc mla
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy