এসএসকেএমে ঢুকছেন মদন মিত্রর স্ত্রী ও ছোট ছেলে। রবিবার শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।
এক জন কতকটা বাধ্য হয়েই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠছেন, আর এক জন উদ্বেগ চাপতে না পেরে আগ বাড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ বলে গলা চড়িয়েছেন। সারদায় সিবিআইয়ের খাঁড়ার মুখে রবিবার রাজ্যের দুই মন্ত্রীকে দুই চেহারায় দেখা গেল।
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এবং বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
মদনের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও একটু বেশি। কারণ এ বার তাঁর বড় ছেলে স্বরূপ মিত্রের বিরুদ্ধেও একটি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার পরিচালন কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগ উঠেছে। স্বরূপ দীর্ঘদিন ওই সংস্থার একটি শাখার (আইকোর গ্লোবাল মেডিসিন লিমিটেড) অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর ছিলেন। কোম্পানি মন্ত্রকের অন্তর্গত গুরুতর জালিয়াতি-সংক্রান্ত তদন্তের ভারপ্রাপ্ত সংস্থা এসএফআইও (সিরিয়স ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অর্গানাইজেশন) সংস্থাটির কার্যকলাপ খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে। সেবি-র হিসেব, ২০১০-১১ আর্থিক বর্ষ পর্যন্ত ৫২৩৯ জন লগ্নিকারীর কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থা (আইকোর) ৫৪.৭৫ কোটি টাকা তুলেছে। সংস্থাটির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটও তদন্ত চালাচ্ছে। মদন-পুত্র নিজে অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহর অভিযোগ, “পরিবহণমন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে ৫৫ কোটি টাকা জালিয়াতি ধরা পড়েছে। গোটা পার্টিটাই জালিয়াত।”
বিপদ যত ক্ষণ স্রেফ তাঁর নিজের মাথার উপরে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তত ক্ষণ এক ভাবে বিষয়টিকে দেখছিলেন পরিবহণমন্ত্রী। এখন অভিযোগের তির ছেলের দিকেও ঘুরে যেতে গলা চড়িয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। রবিবার আনন্দবাজারকে মদন বলেন, “আমার বা আমার পরিবারের কারও যদি চিটফান্ডওয়ালাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রমাণ হয়, লিখে রাখুন মন্ত্রিত্ব-টিত্ব সব ছেড়ে দেব।” তবে মদনের এই হুঙ্কার ঠিক আত্মবিশ্বাস বলে মানছেন না তাঁর দলেরই একাংশ। তাঁদের মতে, সিবিআইয়ের মুখোমুখি হওয়া অনিবার্য বুঝেই নিজের ঘনিষ্ঠদের কিছুটা চাঙ্গা করতে পরিবহণমন্ত্রীর এই কৌশল। এমনিতে উডবার্ন ওয়ার্ডের ২১ নম্বর কেবিনে দিনটা মুখ ব্যাজার করে প্রায় শুয়েই কাটিয়েছেন মদন। গুটিকয়েক অনুচর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলেন। মদন-ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, খুচখাচ কথা বলতে গিয়ে তাঁরা কেউ কেউ মন্ত্রীর কাছে কড়া ধমক খেয়ে চুপসে গিয়েছেন। সব মিলিয়ে ভিআইপি রোগীর কেবিনে থমথমে পরিবেশ। দিনভর সামান্যই ভাত মুখে তুলেছেন। এসএসকেএমের ডাক্তারদের ব্যাখ্যা, এই অরুচির নেপথ্যে কোনও অসুস্থতা নেই। বরং এ হল অবসাদের লক্ষণ। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠেরা যদিও বলছেন, গাদাখানেক কড়া ওষুধের প্রভাবেই ‘দাদা’র জিভে সাড় নেই।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, মদনের অবস্থা স্থিতিশীল। খুব বেশি হলে আর দু-একদিনের মধ্যেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে মদন নিজেও দাবি করেন, “আমি এখন অনেকটাই সুস্থ। দ্রুত ছাড়া পাব। সিবিআই জেরায় কোনও সমস্যা নেই।” দলের অন্দরে অনেকেরই বক্তব্য, এ কথা বলা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই মদনের। কারণ, সিবিআই জেরা যে এড়ানো যাবে না, এটা মন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন। সিবিআইও পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছে। খোদ সিবিআইয়ের অধিকর্তা রঞ্জিৎ সিন্হা এ দিন বলেন, “সিবিআইয়ের নিজের মেডিক্যাল টিম পাঠানোই যেত। আমরা শুধু দেখছি, তার কোনও দরকার পড়ে কি না।”
এমতাবস্থায় মদন যেমন গলার জোর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, শ্যামাপ্রসাদ আবার গলা চড়াতে গিয়ে বাড়তি কথা বলে বসেছেন। যাশুনে বিরোধীরা বলছেন, এ তো ‘রান্নাঘরে কে, আমি কলা খাইনি’ বলারই সামিল!
কী রকম?
এ দিন বাঁকুড়া শহরের উপকণ্ঠে বিকনায় যুব তৃণমূলের কর্মিসভা ছিল। সেখানে বক্তৃতা করার সময় খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই মন্ত্রী টেনে আনেন সিবিআই তলবের প্রসঙ্গ। বলে ওঠেন, “আমি একটা কারখানা বিক্রি করেছি। তাতেই আমাকে জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে আমার বিশেষ কিছু বলা উচিত নয়। তা-ও আমি বলছি, সব তথ্য দিয়ে এসেছি।”
এর পরেই তাঁর মন্তব্য, “শুভেন্দুকেও (অধিকারী) তো কিছু দিন আগে ডেকেছিল সিবিআই!” ঘটনাচক্রে ওই সভাতে তমলুকের সাংসদ শুভেন্দুরও আসার কথা ছিল। শ্যামাপ্রসাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার কিছু পরেই পৌঁছন তিনি। তিনি অবশ্য তাঁর বক্তৃতায় সারদার কথা সরাসরি তোলেননি। শুধু বলেছেন, অপপ্রচার করে তৃণমূলকে দমানো যাবে না।
শ্যামাপ্রসাদের কথাবার্তা-হাবভাবে এ দিন যে একটা চাপের ছায়া দেখা গিয়েছে, সেটা অস্বীকার করছেন না দলীয় কর্মীরাও। এ দিন সভায় উপস্থিত থাকা কিছু তৃণমূল কর্মী বললেন, “শ্যামদাকে এ দিন আগাগোড়া মনমরা দেখলাম! বক্তব্য রাখার সময়েও তাঁকে কেমন জড়োসড়ো মনে হচ্ছিল।” অথচ শুক্রবার জেরা থেকে বেরিয়েও তিনি সাংবাদিকদের বেশ সহজ ভাবেই বলেছিলেন, “ওরা যা জানতে চেয়েছিল বলেছি। আরও কিছু তথ্য চেয়েছে। দিয়ে দেব।”
কীসে তা হলে বদলে গেল শ্যামাবাবুর সুর? দলের অন্দরের খবর, সৃঞ্জয় বসুর গ্রেফতারির খবরই সব এলোমেলো করে দিয়েছে। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে মদনের মতোই শ্যামাপ্রসাদের মনেও আতঙ্ক ক্রমশ চেপে বসছে বলে মনে করছেন বাঁকুড়ার তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। ২০০৬ সালে বাঁকুড়া সদর থানার বেলবনি গ্রামে সিমেন্ট কারখানা গড়ে তুলেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ (তখন তিনি জেলা কংগ্রেস সভাপতি)। ২০০৯ সালে ওই কারখানা সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে বিক্রি করেছিলেন তিনি। তাই নিয়েই জেরার মুখে পড়তে হয়েছে শ্যামাবাবুকে। আনন্দবাজারকে নিজেই একবার বলেছিলেন, “সিমেন্ট কারখানায় লাভ হচ্ছিল না। খদ্দের পেয়েছিলাম, তাই বেচে দিই। তখন সারদার নাম এত শোনাও যেত না। ভাবতেই পারিনি, এই রকম দিন আসতে পারে!”
কিন্তু এখন যে দিনকাল ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছে, সেটা আর অজানা নেই কারওরই। শ্যামাবাবু তাই বক্তৃতায় বলছেন, “এ সব ব্যাপারে যা বলার, তা আমাদের নেত্রী বলছেন। আসলে একটা ফাঁদে ফেলা হয়েছে।” শ্যামার ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত, যুব তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি সুরজিৎ মুখোপাধ্যায় মঞ্চ থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখছেন, “সিবিআই ওঁকে গ্রেফতার করলে অমিয় পাত্র (সিপিএমের জেলা সম্পাদক), সুভাষ সরকার (বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি) বাড়ি থেকে বের হতে পারবেন না! বেরোলেই ঘেরাও হবেন।”
আগ বাড়িয়ে কেন এত কথা বলতে হচ্ছে? শ্যামাপ্রসাদ ভাঙলেও মচকাতে চাইছেন না। তাঁর বক্তব্য, “আমার যতটা বলা উচিত, ততটাই বলেছি। আসলে তো আমাকে ফাঁদেই ফেলা হয়েছে! কর্মীদের সঠিক খবরটা দিতেই ও কথা বলেছি।”
বিরোধীরা কিন্তু এই আগাম ‘সাফাই’ নিয়ে প্রবল ভাবে বিঁধছেন। অমিয় পাত্র বলেছেন, “উনি আগে থেকেই নিজেকে নির্দোষ বলে সাফাই গেয়ে প্রকৃতপক্ষে নিজের দোষী হওয়ারই ইঙ্গিত দিলেন।” সুভাষ সরকারের মন্তব্য, “বস্ত্রমন্ত্রীকে তো কেউ দোষী সাব্যস্ত করেনি। তা হলে আগ বাড়িয়ে উনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন কেন? এর থেকেই স্পষ্ট, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!”
তথ্য সহায়তা: রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy