Advertisement
১৯ মে ২০২৪
হাসপাতালের ছাড়পত্রে প্রশ্ন

কাজে না গিয়ে টোটোয় ব্যস্ত ‘অাহত’ শ্রমিক

একসঙ্গে উপার্জনের দু’টো রাস্তা। একটা চটকলে। অন্যটা টোটো চালিয়ে। যে সময়টায় কারখানায় কাজ করার কথা, তখন দিব্যি টোটো চালাচ্ছেন ভদ্রেশ্বরের ভিক্টোরিয়া জুটমিলের শ্রমিক বিজয়সিংহ পাসোয়ান!

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাপস ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০৩:১৪
Share: Save:

একসঙ্গে উপার্জনের দু’টো রাস্তা। একটা চটকলে। অন্যটা টোটো চালিয়ে। যে সময়টায় কারখানায় কাজ করার কথা, তখন দিব্যি টোটো চালাচ্ছেন ভদ্রেশ্বরের ভিক্টোরিয়া জুটমিলের শ্রমিক বিজয়সিংহ পাসোয়ান!

শুধু তিনি একা কেন, হুগলির ভদ্রেশ্বের জুটমিল, অ্যাঙ্গাস, ডালহৌসি, নর্থ ব্রুক ভিক্টোরিয়া এবং গান্দোলপাড়া জুটমিলের বহু কর্মীই যেন এক এক জন বিজয়সিংহ। মাসের পর মাস মিলের চাকরিতে হাজিরা না দিয়েও বেতন পাচ্ছেন তাঁরা। হুগলির ওই সব জুটমিলের বহু শ্রমিক এটাকেই নিয়ম বানিয়ে নিয়েছেন।

কিন্তু কী ভাবে? মিল কর্তৃপক্ষই বা এমনটা হতে দিচ্ছেন কেন? আসলে আইন শ্রমিকদেরই পক্ষে। শ্রমিক-আইনের ফাঁক গলে দিব্যি দুই জায়গা থেকে একসঙ্গে উপার্জন করছেন ওঁরা।

জুটমিলে কাজ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়লে কিংবা কর্মক্ষেত্রে কোনও আঘাত পেলে, কাজ না করেও মাসের পর মাস বেতন পাওয়া যায়। ইএসআই হাসপাতালের চিকিৎসকের ছাপ মারা কাগজ থাকলেই হল। আর সেই কাগজ নিয়েই ‘কাজে অক্ষম’ বিজয়সিংহেরা এড়িয়ে যাচ্ছেন মিল। মন দিচ্ছেন নতুন পেশায়।

বিজয়সিংহের কাছে চন্দননগরের গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর দেওয়া যে কাগজটা আছে তাতে বলা হয়েছে, কাজ করতে গিয়ে মারাত্মক আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। ফলে এখন তিনি কাজে অক্ষম। মাস দু’য়েক পর পর হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে ‘আনফিট’ কথাটা ফের লিখিয়ে আনছেন। দেড় বছর ধরে এমনটাই চলছে। আসলে কোনও আঘাতই পাননি বিজয়সিংহ। গোটাটাই সাজানো।

চিকিৎসকেরা এমন ‘অনৈতিক’ কাজ কী ভাবে করছেন? প্রশ্ন উঠছে। আর এখানেই লুকিয়ে আসল গল্প। দাদাগিরি-র গল্প। এমনই দাদাগিরি যে শ্রমিকের শরীরে আঘাত না লাগলে বা কোনও রোগ না থাকলেও চন্দননগরের গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে ‘বিশ্রামে’ থাকার কথা লিখে দিতে হবে। লিখে দিতে হবে কারখানার কোনও দুর্ঘটনায় চোট লাগার ‘গল্প’ও। তার পর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেই বিশ্রামের মেয়াদ বাড়িয়ে যেতে হবে।

চিকিৎসকেরাই বা কেন মেনে নিচ্ছেন এই জুলুম? মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা চন্দননগর গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতালের এক ডেপুটি সুপারের গল্পটা হাসপাতালে কান পাতলেই শোনা যায়। চোট-আঘাত না থাকা এক শ্রমিককে ‘বিশ্রাম’ লিখে দিতে আপত্তি করায় শ্রমিকেরা হাসপাতালের মধ্যেই ওই ডেপুটি সুপারকে এমন মেরেছিলেন যে বহু দিন ভেন্টিলেশনে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। ওই ডেপুটি সুপার আর চন্দননগর গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতালের দিকে পা মাড়াননি। নতুন ডাক্তার যাঁরাই আসেন, তাঁদের ওই ডেপুটি সুপারের গল্প বলে সতর্ক করে দেন শ্রমিকেরা।

আপনার কী ধরনের আঘাত ছিল? বদমেজাজি বিজয়সিংহ পাসোয়ান হিন্দিতে যে জবাবটা দিলেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘নিজের চড়কায় তেল দিন’। গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছেন, অঙ্গ অবশ করার ইঞ্জেকশন নিয়ে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে হাতুড়ি মেরে সামান্য থেঁতলে নিয়ে এসেছিলেন বিজয়সিংহ। ৭০০-৮০০ টাকা দিলে এলাকার অনেক হাতুড়ে চিকিৎসক এটা করে দেন।

তবে মার খাওয়া ডেপুটি সুপারের ধাঁচে আর এক চিকিৎসক ওই হাসপাতালে এসে কর্মীদের ‘ওই সব দাবি’ মানতে অস্বীকার করেছিলেন। তার জেরে দিন কয়েক আগে হাজার দু’য়েক শ্রমিক অর্থোপেডিক বিভাগের আউটডোরে চড়াও হন। তাঁদের দাবি ছল, কারখানায় পাওয়া আঘাতের জন্য ‘টানা বিশ্রাম’-এর কথা লিখে দিতে হবে। চিকিৎসকেরা প্রাণভয়ে পালান। শেষ পর্যন্ত অনির্দিষ্ট কালের জন্য হাসপাতালের অর্থোপেডিক আউটডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়। আতঙ্কিত কর্তৃপক্ষ ইন্ডোরও বন্ধ করে দিতে চাইছেন। সম্প্রতি হাসপাতাল সুপার অভ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় হাসপাতালে এসেছিলেন নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে। তখনও তাঁকে ঘিরে শ’খানেক শ্রমিক অর্থোপেডিক আউটডোর অবিলম্বে চালু করে ফের ‘বিশ্রাম’ লেখা শুরু করার দাবি জানাতে থাকেন।

গোন্দলপাড়া জুটমিলের মালিক সঞ্জয় কাজোরিয়ার কথায়, ‘‘বানানো আঘাতের সংখ্যায় আমরা তিতিবিরক্ত। কেউ ছ’মাস। কেউ আবার দু’বছর ছুটিতে থেকে ফিরছেন। ইএসআই আইন অনুযায়ী, তাঁদের কাজে নিতে বাধ্য আমরা। কারণ কাজে আঘাতের জন্য ছুটি নিলে তাঁকে বরখাস্ত করা যায় না।’’ এই প্রবণতা যে লাগামছাড়া হয়েছে, তা মানছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও। সংগঠনের নেতা অমর প্রামাণিক বলেন, ‘‘নিষেধ সত্ত্বেও এটা চলছে। ‘এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি’ দেখিয়ে ছুটি নিতে গিয়ে অনেক শ্রমিক ডাক্তারদের ভয় দেখাচ্ছেন, মারছেন। নিজের শরীরে নিজেই ছুরি দিয়ে কেটে দেওয়া বা অ্যাসিড দিয়ে ক্ষত করার মতো ঝুঁকিও নিয়ে ফেলছেন।’’

ইএসআই কর্তৃপক্ষ কী বলছেন? ইএসআই-এর ‘মেডিক্যাল বেনিফিট স্কিম’-এর ডেপুটি ডিরেক্টর রাজীব গণচৌধুরী জানান, পশ্চিমবঙ্গে মোট শ্রমিকের মধ্যে ৪ শতাংশ কাজের সময় আঘাত লেগে সাময়িক পঙ্গু বা অসুস্থ হন। তার জন্য বিশেষ ভাতা তাঁরা পান। গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতালে আসা শ্রমিকরা গড়ে ৬০-৭০ শতাংশ আঘাতের জন্য সাময়িক ভাব‌ে পঙ্গু হচ্ছেন। দফতর থেকে বিশেষ ভাতা ( টেম্পোরারি ডিজেবল বেনিফিট) নিচ্ছেন। অথচ বজবজ বা কল্যাণীর মতো শিল্পাঞ্চলে ইএসআই হাসপাতালে এই সংখ্যাটা ১৫-২০ শতাংশের বেশি নয়। রাজীববাবুর কথায়, ‘‘ডাক্তারদের ভয় দেখিয়ে গৌরহাটিতে জোর করে বিশ্রাম লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেই নথি দেখিয়ে ইএসআই কর্তৃপক্ষের থেকে প্রতি মাসে বসে বসে টাকা পাচ্ছেন বহু শ্রমিক।’’

গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতালের সুপার অভ্রজিৎ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘ইএসআই আইন অনুযায়ী, কাজের সময় শ্রমিক আহত হয়ে সাময়িক ভাবে পঙ্গু হলে তিনি বাড়িতে বসে প্রাত্যহিক ভাতার ৯০% পাবেন। গৌরহাটিতে চটকল শ্রমিকেরা যেন-তেন ভাবে এই সুবিধা নিতে চাইছেন। ‘সাময়িক বিশ্রাম’-এর সময় এমনিই ভাতা পাচ্ছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে টোটো চালানো, দোকান চালানো, সুদে টাকা খাটানোর বাড়তি রোজগারের ডবল মজাও আছে।’’

এই ব্যবস্থা কী ভাবে যে বন্ধ করা যাবে হবে, তা জানেন না জুটমিল বা ইএসআই কর্তৃপক্ষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jute mill worker Toto driver Injured
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE