Advertisement
E-Paper

যোগ্য-অযোগ্য তালিকা প্রকাশ করবে এসএসসি, শিক্ষামন্ত্রী ও চাকরিহারাদের বৈঠকে ‘আশার আলো’! রয়ে গেল লাথি-বিতর্ক

শিক্ষা দফতরের আশ্বাস, আইনি পরামর্শ নিয়ে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। ‘মিরর ইমেজ’ প্রকাশেও সরকারের আপত্তি নেই।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:১৭
শুক্রবার চাকরিহারাদের সঙ্গে বিকাশভবনে বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু।

শুক্রবার চাকরিহারাদের সঙ্গে বিকাশভবনে বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। — নিজস্ব চিত্র।

যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করা হোক— সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর থেকে এই দাবিই তুলে আসছেন প্রায় ২৬ হাজার চাকরিহারা শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী। সেই দাবি নিয়েই তাঁরা শুক্রবার দেখা করেছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে। সেখানে শিক্ষা দফতরের আশ্বাস, যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা তৈরি করতে শুরু করেছে এসএসসি (স্কুল সার্ভিস কমিশন)। আইনি পরামর্শ নেওয়ার পরে তা প্রকাশ করা হবে। এই আশ্বাসেই কিছুটা ‘স্বস্তি’তে চাকরিহারারা। তাঁদের দাবির সঙ্গে মৌলিক কোনও বিরোধ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন ব্রাত্যও। তার পরেও কসবাকাণ্ডের ‘কাঁটা’ রয়ে যাচ্ছে।

শুক্রবার আবারও সাংবাদিক বৈঠক করে কলকাতা পুলিশ কসবাকাণ্ড নিয়ে নতুন তত্ত্ব তুলে ধরেছে। এর আগে ‘বাধ্য হয়ে হালকা বলপ্রয়োগ’ কেন করতে হয়েছিল, সেই ব্যাখ্যা দিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। এ বার তারা জানাল, শিক্ষকদের ওই কর্মসূচিতে ছিলেন ‘বহিরাগতেরা’ও। খোদ কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মাও নেমে পড়েন ব্যাট হাতে। তিনি জানান, শিক্ষকেরা সেখানে অশান্তি করবেন, হিংসাত্মক হয়ে পড়বেন, এটা তাঁরা আশা করেননি। যদিও তিনি ফের মেনে নেন, বিক্ষোভকারী শিক্ষককে লাথি মারা ঠিক হয়নি। শিক্ষককে লাথি মারায় অভিযুক্ত সেই সাব ইনস্পেক্টর (এসআই) রিটন দাসকে কসবকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে রিটনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও পরে কসবাকাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার বদলে দেওয়া হয়। যদিও এত কিছুর পরেও পুলিশ নিজের যুক্তিতে অনড়। শুক্রবারও লালবাজারে সাংবাদিক বৈঠকের সময় শিক্ষকদের কর্মসূচির বেশ কিছু ফুটেজ তারা তুলে ধরে। তাদের তরফে জানানো হয়েছে, শিক্ষকেরা অশান্তি করবেন, তা তারা ভাবতে পারেনি। গোলমালের ভিডিয়ো এর আগেও লালবাজার প্রকাশ্যে এনেছে। তাতে এক শিক্ষককে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘পেট্রল নিয়ে আয়, জ্বালিয়ে দেব!’’ পুলিশ সেই কথাকেই ‘হাতিয়ার’ করেছে। তবে বিতর্কে জড়ানো সেই চাকরিহারা শিক্ষক প্রতাপ রায়চৌধুরী এ বার নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, তিনি সরকারি দফতর জ্বালানোর কথা মোটেই বলেননি। তিনি বলেছিলেন নিজেকে ‘জ্বালিয়ে দেওয়া’র কথা।

পুলিশ-চাকরিহারাদের এই সংঘাতের মাঝেই একদল আবার এসএসসি দফতরের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন। সেখানে তিন জন অনশনও করছেন। শুক্রবার সেখানে গিয়ে সমর্থন জানান চিকিৎসকেরাও। সেখানে যান কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে ‘গো ব্যাক’ স্লোগানও শুনতে হয়। তার মাঝেই তিনি যোগ্যদের তালিকা প্রকাশের দাবি তোলেন। যে যোগ্য-অযোগ্য তালিকা নিয়ে জট রয়েছে অনেকটাই। কী ভাবে যোগ্য এবং অযোগ্যদের আলাদা করা হবে, সেই প্রশ্নের এখনও স্পষ্ট কোনও উত্তর নেই। শিক্ষা দফতরের আশ্বাস, আইনি পরামর্শ নিয়েই আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। ‘মিরর ইমেজ’ প্রকাশেও সরকারের আপত্তি নেই। আর তাতেই কিছুটা হলেও ‘স্বস্তি’তে চাকরিহারারা।

তালিকা প্রকাশ

বিকাশ ভবনে শুক্রবার প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যের সঙ্গে বৈঠক করেন চাকরিহারারা। তার পরে তাঁরা জানান, বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে মূলত দু’টি বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। এক, যোগ্য-অযোগ্যদের নামের তালিকা এবং ওএমআরের মিরর ইমেজ প্রকাশ্যে আনা। দুই, আইনি প্রক্রিয়াগুলি নিয়ে আলোচনা। চাকরিহারাদের প্রতিনিধিরা বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে এসএসসির চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, তাঁরা যোগ্য ও অযোগ্যদের তালিকা ইতিমধ্যেই তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছেন। আগামী রবিবারের মধ্যে সেই কাজ শেষ হয়ে যেতে পারে। আইনি পরামর্শ নিয়ে আগামী ২১ এপ্রিলের মধ্যে তা প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করা হবে।’’ তবে জানানো হয়েছে, ওএমআরের প্রকৃত মিরর ইমেজ নেই। যদি তা থাকত, তা হলে সিবিআই তা খুঁজে পেত। সিবিআইয়ের কাছে যে প্রতিলিপি আছে, সেটিই প্রকাশ্যে আনা হবে। যদিও চাকরিহারারা জানান, শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস সত্ত্বেও এখনই স্বস্তি পাচ্ছেন না তাঁরা। যত ক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের দাবি আদায় না-হচ্ছে, তত ক্ষণ পর্যন্ত চলবে আন্দোলন। ব্রাত্যের সঙ্গে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা করেছেন চাকরিহারারা। রিভিউয়ের আবেদন করার আগে কী ধরনের আলোচনা করা হবে, কথা হয়েছে সে সব নিয়েও।

বিরোধ নেই

চাকরিহারাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে ব্রাত্য জানান, চাকরিহারাদের দাবিগুলির সঙ্গে তাঁর মৌলিক কোনও বিরোধ নেই। যে হেতু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে, তাই আইনি পরামর্শ ছাড়া কিছু করা যাবে না। সেই পরামর্শ নিচ্ছে রাজ্য সরকার। আইনি পরামর্শ নিয়েই আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। বিষয়টি নিয়ে বিরোধীদের রাজনীতি না-করার অনুরোধ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। চাকরিহারাদের স্কুলে ফিরতে এবং ক্লাস নিতে বলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘চাকরিহারাদের বলেছি, স্কুলের সঙ্গে আপনারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবেন না। স্কুলে ফিরুন। ক্লাস নিন।’’ এর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁদের স্বেচ্ছা পরিষেবা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

দায়িত্ব থেকে অপসারণ

কসবায় চাকরিহারা প্রার্থীকে লাথি মারার ঘটনায় অভিযুক্ত এসআই রিটনকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। লালবাজার সূত্রে খবর, কসবার ঘটনার তদন্ত করবেন সঞ্জয় সিংহ। কসবা থানায় এসআই পদে আছেন তিনি। গত বুধবার চাকরিহারাদের বিক্ষোভের ভাইরাল ভিডিয়োয় এক আন্দোলনকারীকে লাথি মারতে দেখা গিয়েছিল রিটনকে (ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম)। পরে ওই দিনের ঘটনার তদন্তকারী অফিসার (আইও) হিসাবে নিযুক্ত হন সেই তিনিই। তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। তার মাঝেই শুক্রবার জানা যায়, প্রথমে রিটনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও পরে কসবাকাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার বদলে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্তব্যরত ডিউটি অফিসারকেই আইও হিসাবে নিয়োগ করে লালবাজার। তবে, ধর্ষণের ঘটনা বা পকসোর মতো স্পর্শকাতর মামলার ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা আইও হিসাবে উপযুক্ত অফিসারকে সুপারিশ করে থাকেন।

‘বহিরাগতেরাও জড়িত’

‘বাধ্য হয়ে হালকা বলপ্রয়োগের’ ব্যাখ্যার পরে শুক্রবার নতুন তত্ত্ব শোনাল কলকাতা পুলিশ। তারা জানাল, কসবায় শিক্ষকদের কর্মসূচিতে শুধু শিক্ষকেরা ছিলেন না, ছিলেন কিছু ‘বহিরাগত’ও। ভিডিয়ো দেখিয়ে তারা প্রমাণ করতে চাইল, পুলিশ শান্ত ভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছিল। বিক্ষোভকারীরাই প্রথমে পুলিশকে হেনস্থা করেছেন। পুলিশ কমিশনার (সিপি) মনোজ জানিয়েছেন, শিক্ষকদের কর্মসূচি ছিল বলে সেইমতোই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষকেরা সেখানে অশান্তি করবেন, হিংসাত্মক হয়ে পড়বেন, এটা তাঁরা আশা করেননি। সিপির কথায়, ‘‘শিক্ষকদের তালা লাগানোর কথা ছিল। কিন্তু তালা লাগানো এবং তালা ভাঙা দুটো এক ব্যাপার নয়। শিক্ষকদের বিক্ষোভ। আপনি কী ভাববেন? ওখানে অশান্তি হবে, কেউ প্রত্যাশা করেনি।’’ তবে চাকরিহারা বিক্ষোভকারী শিক্ষককে লাথি মারা উচিত হয়নি বলে শুক্রবারও মেনে নিয়েছেন মনোজ। তাঁর কথায়, ‘‘লাথি মারা উচিত হয়নি। আগেও বলেছি, আজও বলছি। পুলিশের ভুল হতেই পারে। ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তার জন্যও বলা হয় বার বার।’’ পাশাপাশিই সিপি জানালেন, কসবার ঘটনায় রিটনকেও হেনস্থা করা হয়েছে। তিনিও আঘাত পেয়েছেন।

শিক্ষকের ব্যাখ্যা

কলকাতা পুলিশ কসবায় জেলা স্কুল পরিদর্শকের দফতরের সামনে গোলমালের যে ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এনেছে, তাতে এক শিক্ষককে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘পেট্রল নিয়ে আয়, জ্বালিয়ে দেব!’’ বিতর্কে জড়ানো সেই চাকরিহারা শিক্ষক প্রতাপ রায়চৌধুরী এ বার নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, তিনি সরকারি দফতর জ্বালানোর কথা মোটেই বলেননি। তিনি বলেছিলেন নিজেকে ‘জ্বালিয়ে দেওয়ার’ কথা। তাঁর কথায়, ‘‘আমি নিজেকে জ্বালানোর কথা বলেছিলাম। নিজেদের চাকরি যদি সসম্মানে ফিরে না পাই, তা হলে নিজেকে জ্বালিয়ে দেওয়া ছাড়া, ফাঁসিতে ঝুলে যাওয়া ছাড়া বা আত্মহনন ছাড়া আমাদের আর কোনও পথ নেই।’’ প্রতাপ সোনারপুর এমসি হাই স্কুলের নবম-দশমের শিক্ষক। তিনি জানিয়েছে, ঋণ রয়েছে তাঁর। ঘরে সন্তান রয়েছে। তার মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। কলকাতা পুলিশ যে ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এনেছে, সেখানে প্রতাপকে অবশ্য নিজেকে জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলতে শোনা যায়নি। এ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে চাকরিহারা শিক্ষক বলেন, ‘‘এতে আমি কী করব? সব কথা কি ওইটুকু ক্লিপে হয় নাকি? ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিন। গুলি করুন আমাদের। আমি শুধু একটাই কথা বলতে চাই, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার কোনও অভিপ্রায় আমাদের নেই। আমরা আইনত নিয়োগপত্র পেয়েছি। আবার আইনতই নিয়োগপত্র ছিনিয়ে আনব। সিবিআই যে অযোগ্যদের তালিকা দিয়েছে, তাতে কি আমার নাম রয়েছে? প্রমাণ করে দেখাক আমি অযোগ্য।’’

‘গো ব্যাক’ স্লোগান

শুক্রবার এসএসসি দফতরের সামনে রাস্তায় বসে পড়েন চাকরিহারাদের একাংশ। তাঁরা জানান, সেখান থেকেই নিজেদের দাবিদাওয়া জানাবেন তাঁরা। সেখানে অনশন করছেন তিন শিক্ষক। চাকরিহারাদের আন্দোলনকে সংহতি জানাতে এসএসসি দফতরের সামনে যান চিকিৎসকেরাও। শুক্রবার বিকেলে সেখানে যান কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা বর্তমান বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ। সেখান থেকে চাকরিহারাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘গত পরশু আমরা চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলাম দ্রুত যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা তৈরি করুন। বলেছিলাম সেই তালিকা নিয়ে আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাব, যাতে যোগ্যদের গায়ে কোনও আঁচ না-লাগে। আশা করেছিলাম দু’দিনের মধ্যে হয়তো সেই তালিকা প্রকাশ্যে আসবে। কিন্তু তা হয়নি। আমরা রাজ্য সরকারকে আর দু’ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। তার মধ্যে যদি তারা এসএসসিকে নির্দেশিকা পাঠান, তা হলেই বোঝা যাবে চাকরি ফেরানোর সদিচ্ছা তাঁদের রয়েছে।’’ যখন নিজের বক্তব্য জানাচ্ছেন অভিজিৎ, তখন ‘গো ব্যাক স্লোগান’ দেন আন্দোলনকারীদের একাংশ। এই নিয়ে প্রাক্তন বিচারপতিকে কটাক্ষ করেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘শুনলাম চাকরিহারাদের অনশনমঞ্চে গিয়ে অভিজিতকে গো ব্যাক শুনতে হল। এটা তো হওয়ারই ছিল!’’

Bratya Basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy