• তাঁরা লৌহকপাটের বাসিন্দা, কিন্তু এখনও দোষী সাব্যস্ত হননি।
• কারাগারে দণ্ডিতদের যে-সব কাজ করতে হয়, সেগুলো ওঁদের জন্য বরাদ্দ নয়। ওঁরা প্রায় ঝাড়া হাত-পা।
• খেলাধুলো, নাটক, নাচগান— গারদের ভিতরে স্বাস্থ্য বা সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ নেই।
তবু তাঁরা জেলেই আছেন বছরের পর বছর। এবং তাঁরাই জেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা বিচারাধীন বন্দি। জেলে থেকেও তাঁরা এক ‘নেই রাজ্য’-এর বাসিন্দা। সেই সঙ্গে তাঁরাই জেলের মূর্তিমান ‘বাজার’।
কারাকর্তাদের বক্তব্য, আইনের চোখে এখনও দোষী সাব্যস্ত না-হওয়া ওই বন্দিদের একটা বড় অংশই জেলের মাথাব্যথার মূল কারণ। কেননা জেল ওঁদের কাছে এখনও সংশোধনাগার হয়ে ওঠেনি। কাজের বালাই না-থাকায় নানান অকাজে লিপ্ত হওয়াই ওঁদের একমাত্র কাজ।
কারা দফতরের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট বলছে, বিচারাধীন বন্দিদের অখণ্ড অবসরই অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। কখনও মাদকের প্রতি আসক্তি বাড়ে। কখনও বা জেলে বসেই তোলাবাজি-সহ বাইরের জগতের নানা অপরাধমূলক কাজে নাম জড়িয়ে যায় অনেকের। এমন সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে কিছু জিনিসপত্রের প্রয়োজন, যা জেলের অন্দরে ঢোকা বারণ। এক প্রাক্তন কারাকর্তা বলেন, ‘‘মুশকিল আসান করে দেন কারারক্ষীদের একাংশই। আর তাঁদের মাধ্যম হয়ে ওঠেন কিছু দণ্ডিত বন্দি। বিচারাধীন বন্দিদের একটা বড় অংশই জেলের ভিতরে অশান্তির মূল কারণ।’’
‘‘জেলে বিচারাধীন বন্দি একটা বড় বাজার,’’ বলেন এক কারাকর্তা। মাদক, মোবাইল থেকে জেলের মধ্যে ‘ভাল থাকা’, ‘ভাল খাওয়া’ বিক্রি হয় ওঁদের কাছেই। ওঁরা না-থাকলে জেলে এ-সবের খদ্দেরও নেই। কারারক্ষীদের একাংশকে বাদ দিলে বাইরে থেকে মাদক-সহ নানা নিষিদ্ধ দ্রব্য ঢোকার মাধ্যম বিচারাধীন বন্দিরাই। কারণ, আদালতে হাজিরার জন্য তাঁরাই বারবার বাইরে যাওয়ার সুযোগ পান। ফেরার পথে জেলে নিয়ে আসেন মাদক, ব্লেড-সহ নানান নিষিদ্ধ দ্রব্য।
বিচারাধীন বন্দিদের একটা বড় অংশ দাগি অপরাধী। কারাকর্তাদের ভাষায়, তাঁরা কার্যত ‘জেলে বেড়াতে আসেন’। এই বন্দিরাই মোবাইলের মাধ্যমে বাইরে হুমকি দেন। তোলা আদায় করেন। ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে হরেক কিসিমের অপরাধমূলক কাজকর্ম চালিয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে অবশ্যই যোগসাজশ থাকে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি এবং কারারক্ষীদের একাংশের।
কারা দফতরের হিসেব অনুযায়ী রাজ্যের জেলগুলিতে এখন ওই বিচারাধীন বন্দিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাজ্যের ৫৯টি জেলে মোট ২২ হাজার ৫০০ বন্দি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৬ হাজার ৫০০ জনই বিচারাধীন। কলকাতার তিন সেন্ট্রাল জেলে মোট বন্দির সংখ্যা ৬,৭০০। তাঁদের মধ্যে বিচারাধীন চার হাজার। রাজ্যের জেলা ও মহকুমা জেলগুলিতে কার্যত সাজাপ্রাপ্ত বন্দিই নেই। সব ক’টাই বিচারাধীন বন্দিতে ভর্তি!
কারাকর্তাদের বক্তব্য, বিচারাধীন বন্দির এই বিপুল সংখ্যা দেশের সব জেলের কাছেই একটা বড় সমস্যা। এই সংখ্যা কমানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট বারবার নিম্ন আদালতগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে। কাজ হয়নি। অগত্যা রাজ্যের ৭০% জেল ভরে রয়েছে বিচারাধীন বন্দিতেই। আর তাঁদের ঘিরেই চলছে জেলের অপরাধ চক্র। দমদম জেলের সাম্প্রতিক হাঙ্গামার পিছনেও ওই বিচারাধীন বন্দিদের একাংশের উস্কানি রয়েছে বলে মনে করছেন কারাকর্তারা।
কিন্তু ওই বন্দিদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে না কেন? আইন ও বিচার দফতরের এক অফিসারের বক্তব্য, ওটা বিচার বিভাগের বিষয়। আদালতেও সমস্যা রয়েছে। পর্যাপ্ত বিচারক নেই। তবে কলকাতা হাইকোর্টের এক আইনজীবী জানান, হুটহাট ছুটি, বারবার তারিখ পড়তে থাকায় বিচার পাচ্ছেন না অনেকে। যে-অভিযোগে ধরা হয়েছে, দোষী সাব্যস্ত হলে তাতে হয়তো সর্বাধিক আট বছর জেল হওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচ-ছ’বছর কারাবাসের পরেও তাঁদের বিচার হয়নি। এ ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্বও এড়িয়ে যাননি ওই আইনজীবী। ‘‘নানা কারণ দেখিয়ে আইনজীবীদের অনেকেই বন্দিদের জন্য জুনিয়রদের আদালতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা গরহাজির থাকেন। মামলা ঝুলেই থাকে।’’
২২৫০০
কলকাতার ৩ জেল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy