E-Paper

পাঁকের পলি থেকে শহরে আয়ও হয় না সেচ দফতরের

খাল সংস্কারে খরচ হয় সরকারের কোটি কোটি টাকা। কিন্তু খালগিলির শ্রী ফেরে না। কেন? কোথায় সমস্যা? খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৫ ০৯:৩৯
গড়িয়ার কাছে বসতি এলাকায় এ ভাবেই আবর্জনা জমে দূষিত হচ্ছে খাল।

গড়িয়ার কাছে বসতি এলাকায় এ ভাবেই আবর্জনা জমে দূষিত হচ্ছে খাল। —নিজস্ব চিত্র।

কয়েক বছর আগের কথা। সেচ দফতরের বৈঠক। সেখানে স্লাইড শো-এর ছবিতে খালের ভয়াবহ ছবি দেখে আঁতকে ওঠেন এক উচ্চপদস্থ কর্তা। সেই সব ছবিতে দেখানো হয়েছিল, খাল থেকে পলির সঙ্গে কী কী আবর্জনা ওঠে সংস্কারের সময়ে। মৃত পশুর দেহাংশ, টায়ার, প্রতিমার কাঠামো, প্লাস্টিক— কী নেই তাতে।

শহরের বিভিন্ন খালের রক্ষণাবেক্ষণ প্রসঙ্গে সেচ দফতর সূত্রের খবর, পরিস্থিতি এখনও সেই তিমিরেই। খাল থেকে পলি তোলার পরে পাঁকের সঙ্গেই পড়ে থাকে এমন আবর্জনার স্তূপ। সম্প্রতি সেচ দফতর একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাতে খাল সংস্কারের কাজ করা সংস্থা পলি নিয়ে যাবে। বিনিময়ে সেচ দফতরকে তার দাম দেবে তারা। যদিও কলকাতার খালগুলি থেকে আয়ের বিশেষ উপায় নেই। সেচ দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, গ্রাম বা মফস্‌সলের নদী ও খালের পলিতে এত আবর্জনা থাকে না। সেখানে অনেক পরিমাণে মাটি ওঠে। সেই পলি ইটভাটা কিংবা মাটি ভরাটের কোনও প্রকল্পে কাজে লেগে যায়। তাই সংস্কারের কাজ করা সংস্থাগুলিরও ওই পলি নিয়ে উৎসাহ থাকে। কিন্তু কলকাতার যে কোনও খাল থেকে তোলা পলিতে পূতিগন্ধময় পাঁক আর আবর্জনা ছাড়া কিছু থাকে না। সম্প্রতি খাল সংস্কারের পরে ক্যানাল ইস্ট রোডের ধারে জমে রয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত এমনই পলি, অভিযোগ এসেছে স্থানীয় এলাকা থেকে। ওই এলাকার বাসিন্দা রোহন দাসের অভিযোগ, ‘‘দুর্গন্ধে দরজা-জানলা খোলা যাচ্ছে না। খালপাড়ে জমে থাকা ওই নোংরার স্তূপ রোদে শুকিয়ে যাওয়ায় তা থেকে আবর্জনা উড়ে সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর বৃষ্টি হলে রাস্তায় কাদা ভরে থাকছে।’’ বছর দুয়েক আগে এ ভাবেই কেষ্টপুর খালের দু’পাড়ে নোংরা পলি জমে থাকায় দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়েছিল সল্টলেকের বাসিন্দাদের।

কলকাতা ও আশপাশের বিভিন্ন খালের দুরবস্থা দেখে হতাশ ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই। তাঁদের অভিযোগ, খালের পাড়ে লোহার বেড়া দিলেও তা ভেঙে দেওয়া হয়। এমনকি, বেড়াটাই চুরি করে লোহার দরে বেচে দেওয়া হয়। বেলেঘাটার দিক থেকে খালপাড় বরাবর বিভিন্ন জায়গায় লোহার জাল কিংবা রেলিং ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই সব ভাঙা অংশে প্লাস্টিক-সহ নানা আবর্জনা জমে আছে স্তূপীকৃত হয়ে। বেড়া ভেঙে দেওয়ার পরে প্রতি বার নতুন করে খালপাড় ঘেরার মতো আর্থিক ক্ষমতা কিংবা লোকবল, কোনওটাই যে তাঁদের নেই, তা জানিয়ে দিয়েছেন আধিকারিকেরা।

পরিবেশকর্মীরা মনে করেন, ঠিক মতো পরিকল্পনা করা হলে খালগুলি শহরের সৌন্দর্যায়নের বড় অংশ হয়ে উঠতে পারত। সল্টলেকের এএ ব্লকের এক বাসিন্দার অভিযোগ, ‘‘এ দিকে কেষ্টপুর খালপাড় সাজানো হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার পরে মশার উপদ্রবে সেখানে বসার উপায় নেই। এমন সৌন্দর্যায়ন করে তবে লাভ কী হল?’’ জোকার চড়িয়াল কিংবা বেলেঘাটার সার্কুলার খালের মতো বড় খাল এবং পূর্ব কলকাতার আনন্দপুর ও ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশনের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের আশপাশের বাসিন্দারাও জানিয়েছেন, মশার যথেষ্ট উপদ্রব রয়েছে। কচুরিপানা জমে থাকায় খালের জল সরে না।

অনেকেই মনে করেন, শহরে বড় বড় আবাসন তৈরি হচ্ছে বলে সেই সব জায়গায় কাজ পাওয়ার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে কলকাতায় এসে বসতি গড়ে তুলছেন বহু মানুষ। তাঁদের বেশির ভাগেরই পছন্দ খালের পাড় অথবা রেললাইনের ধারের জায়গা।এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক দলগুলির, বিশেষত শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে। পরিবেশবিদদের মতে, খালের পাড় দখলমুক্ত রাখতে অথবা খালে আবর্জনা ফেলা আটকাতে নিয়মিত সচেতনতা তৈরির কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরই সে কাজে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কলকাতার কোনও খালপাড়ে গিয়ে চোখে পড়েনি সচেতনতা প্রচারের কোনও বোর্ড বা জরিমানার হুঁশিয়ারি। সেচ দফতর সূত্রের খবর, আগে খাল দূষিত না করার জন্য টিভিতে ঘোষণা হত। এখন সব বন্ধ।

পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণে নেই, তা কার্যত মেনে নিয়ে মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘পুরসভার প্লান্টে পৌঁছনোর আগেই প্লাস্টিক খালে ফেলে দিচ্ছেন কুড়ানিরা। সেই দূষণ শুধু খালেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সেই জল গিয়ে গঙ্গায় পড়ছে। শহরের মানুষ তা পানও করছেন। অন্যত্র ঘর-বাড়ি থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ খালধার দখল করে রেখেছেন। প্রশাসন কড়া ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে শহরের নিকাশি ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু ঠিক মতো রক্ষণাবেক্ষণ করলে খালপাড়ের উন্নয়ন করে শহরের হাল বদলে দেওয়া যেতে পারে। টালিনালায় সৌন্দর্যায়নের একটি প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি।’’

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

garbage drainage

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy