Advertisement
E-Paper

প্রবীণ বিধায়ক-ডাক্তারের পরিজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়েই বিরূপাক্ষ ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-তে! তার পরই উত্থান

বিরূপাক্ষের দাবি, “আমি এক জন সাধারণ চিকিৎসক। অন্যান্যদের মতো রোগী পরিষেবাই একমাত্র লক্ষ্য। কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে আমার নামে মিথ্যাচার করছেন, জানি না। আমিও বিচারের দাবি করেছি।”

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:০৫
স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় নয়, একটি মেডিক্যাল কলেজের সমাবর্তন। ডিগ্রি দিচ্ছেন সম্প্রতি সাসপেন্ড হওয়া সিনিয়র রেসিডেন্ট বিরূপাক্ষ বিশ্বাস। আবার সেই গাউন পরে, যা সচরাচর উপাচার্য বা ডিনদের গায়ে দেখা যায়।

স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় নয়, একটি মেডিক্যাল কলেজের সমাবর্তন। ডিগ্রি দিচ্ছেন সম্প্রতি সাসপেন্ড হওয়া সিনিয়র রেসিডেন্ট বিরূপাক্ষ বিশ্বাস। আবার সেই গাউন পরে, যা সচরাচর উপাচার্য বা ডিনদের গায়ে দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত।

অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র দাপুটে নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তাই খুব সহজে সিনিয়রদের তো বটেই, জুনিয়র চিকিৎসকদের একাংশকেও কব্জা করে ফেলেছিলেন বর্ধমান মেডিক্যালের আরএমও অভীক দে। আর সেই ‘সৈন্য-বাহিনী’ নিয়ে, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠীর সিন্ডিকেট গড়ে তোলা সহজ হয়েছিল বলেই অভিযোগ চিকিৎসক মহলের বড় অংশের।

ওই চিকিৎসকদের অভিযোগ, সিনিয়রদের পদোন্নতিতে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জুনিয়রদের কাঁচা-টাকার প্রলোভন দেখানো ছিল সিন্ডিকেটে সদস্য বাড়ানোর অন্যতম পন্থা। যা নিয়ন্ত্রণ করতেন অভীক। মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটির সদস্য এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের অন্যতম সদস্য হওয়ায়, সাধারণ আরএমও হয়েও অভীক ছিলেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘বেতাজ বাদশা’। অভিযোগ, তাঁর হাত ধরে স্বাস্থ্য প্রশাসনের শীর্ষস্তরে কয়েক জন বড় পদ পেয়েছিলেন। সেই সুবাদে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রশাসনে ছড়ি ঘোরানো সহজ হয়েছিল অভীকের।

তেমনই, কাউকে ভয় দেখিয়ে, আবার কাউকে প্যাঁচে ফেলে নিজের দলে যোগ দিতেও তিনি বাধ্য করতেন বলে অভিযোগ উঠছে। যেমন ভাবে সম্প্রতি সাসপেন্ড হওয়া সিনিয়র রেসিডেন্ট বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-তে প্রবেশের কথা বলছেন তাঁর সমসাময়িক ডাক্তারেরা। জানা যাচ্ছে, কামারহাটি সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ার সময়ে রাজ্যের এক চিকিৎসক-বিধায়কের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিরূপাক্ষ। সেই চিকিৎসক-নেতা ও কামারহাটির স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার কাছাকাছি থেকে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে অনৈতিক কাজকর্ম বিরূপাক্ষ শুরু করেন বলে অভিযোগ।

কিন্তু শাসক দলের ওই দুই নেতা বিরূপাক্ষকে তেমন ভরসা করতেন না। বরং ওই মেডিক্যাল কলেজের আর এক ছাত্রনেতাকে তলেতলে মদত দিতে থাকেন তাঁরা। সেই ক্ষমতাবলে ২০২২ সালের জুলাইয়ে অবৈধ ভাবে হস্টেল দখল করে রাখা ও দাদাগিরি করার জন্য বিরূপাক্ষের উপর চড়াও হন শাসক দল ঘনিষ্ঠ পড়ুয়ারাই। বিরূপাক্ষ গ্রেফতার হন। সেই সময়ে সাগর দত্ত মেডিক্যালে গিয়ে বিরূপাক্ষকে বার করে দেওয়া পড়ুয়াদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে আসেন অভীক। কিন্তু সব কিছু ওলটপালট করে দেয় কোভিড।

অতিমারির আগে থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ছিলেন মেরেকেটে কয়েক জন চিকিৎসক। তাঁদের মধ্যে এক জন চিকিৎসক-বিধায়ক (যাঁকে বিরূপাক্ষ আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন) নিজের ক্ষমতা জাহির করে বেড়াতেন। কিন্তু তাঁর বিভ্রান্তিকর মন্তব্য, বেআইনি কর্মকাণ্ডে ক্রমশ অস্বস্তিতে পড়তে শুরু করে শাসক দল। আবার তৎকালীন এক সাংসদ-চিকিৎসক প্রতি মুহূর্তে ওই গোষ্ঠীর বিরোধিতা করতে থাকেন। উত্তরবঙ্গের চিকিৎসক সুশান্ত রায় বিশেষ গুরুত্ব পেতে শুরু করেন ওই গোষ্ঠীতে। জানা যায়, তাঁর পরামর্শে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-র শীর্ষস্তর থেকে বাদ পড়েন ওই বিধায়ক-চিকিৎসক। বদলে সুনজরে আসেন আর এক প্রবীণ বিধায়ক-চিকিৎসক।

সুযোগ বুঝে বিরূপাক্ষ ওই প্রবীণ বিধায়ক-ডাক্তারের পরিজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ঢুকে পড়েন ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-তে। অভীক তখন বিরূপাক্ষকে দায়িত্ব দেন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ এবং জেলাস্তরের হাসপাতালে তাঁদের বিরুদ্ধে থাকা লোকজনকে শায়েস্তা করার। সেই মতো সিনিয়রদের ফোন করে কটূক্তির পাশাপাশি, জুনিয়রদের ফেল করানো বা মারধরের ভয় এবং পাশ করানোর প্রলোভন দেখিয়ে টাকা তোলার অভিযোগ রয়েছে বিরূপাক্ষের বিরুদ্ধে।

২০২২-এ রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের ভোটেও বিভিন্ন সিনিয়র ডাক্তারকে হুমকি এবং ভয় দেখানোর অভিযোগ রয়েছে বিরূপাক্ষের বিরুদ্ধে। প্রবীণ বিধায়ক-চিকিৎসক সভাপতি, সুশান্ত রায় সহ-সভাপতি হয়ে যাওয়ায় বিরূপাক্ষও ‘কেউকেটা’ হয়ে ওঠেন বলেই অভিযোগ চিকিৎসক মহলের। সেই ক্ষমতাবলে সাগর দত্ত মেডিক্যালেও ঢুকে পড়েন বিরূপাক্ষ। এক সময়ে যাঁরা তাঁকে তাড়িয়েছিলেন, তাঁরাও সমঝোতা করে নেন। রবিবার বা ছুটির দিনে সাগর দত্ত মেডিক্যালে গিয়ে ওই সমস্ত চিকিৎসক-পড়ুয়াকে সঙ্গে নিয়ে বিরূপাক্ষ বিভিন্ন দুর্নীতির ছক কষতেন বলেও অভিযোগ। বেশ কিছু মেডিক্যাল কলেজে নিজস্ব বাহিনী তৈরি করেন বিরূপাক্ষ। তাঁদের মাধ্যমে ছোটখাটো বদলি, পদোন্নতির সুপারিশও ‘লবি’র কাছে তিনি নিয়ে আসতেন। এক সময়ে গাড়িতে নীলবাতি ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

তবে বিরূপাক্ষের দাবি, “আমি এক জন সাধারণ চিকিৎসক। অন্যান্যদের মতো রোগী পরিষেবাই একমাত্র লক্ষ্য। কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে আমার নামে মিথ্যাচার করছেন, জানি না। অন্যদের মতো আমিও বিচারের দাবি করেছি।”

সিন্ডিকেটে বিরূপাক্ষের মতো আরও কয়েক জনকে বিশেষ কাজের জন্য বেছে নেন অভীক। অভিযোগ, তাঁদের এক জন আর জি করের সিনিয়র রেসিডেন্ট সৌরভ পাল। কোন ডাক্তারের কোথায় পোস্টিং, সেই তালিকা সৌরভের নখদর্পণে ছিল। অভীকও সন্দীপ ঘোষের ‘স্নেহভাজন’ সৌরভের মাধ্যমে বদলি-পদোন্নতির সুপারিশ পৌঁছে দিতেন স্বাস্থ্য ভবনে। তবে সৌরভের দাবি, “পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছুতে আমি ছিলাম না।”

R G Kar Hospital Birupaksha Biswas CBI
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy