নিজস্ব চিত্র
হাতি অনেক দেখেছে মেদিনীপুর। দেখেই থাকে। বাৎসরিক ব্যাপার বাসিন্দাদের হস্তিদর্শন। দলমা পাহাড় থেকে যূথপতি তার দলবল নিয়ে আসে। থাকে। ফসল নষ্ট করে। হুলা পার্টির তাড়া খায়। তারপর আবার ফিরে যায়। কোনও কোনও গজরাজ জঙ্গলমহলকেই ঘরবাড়ি বানিয়ে রেসিডেন্ট হয়ে যায়।
জেলার জীবন-ইতিহাস লিখলে হাতি সে ইতিহাসে অবশ্যই ঠাঁই পেয়ে যাবে। কিন্তু বাঘ? সে একা এবং অদ্বিতীয়। মাসতিনেক ধরে ঝাড়গ্রাম এবং মেদিনীপুরের জনজীবন ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল বাংলার রাজকীয় বাঘটি। আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে আলোড়ন তোলা রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য শেষ হয় বাঘটির মৃত্যুতে। এমন প্রাণীটি ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ারই তো কথা। পেয়েছে সে।
মেদিনীপুর শহরে একটি সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছে। কালেক্টরেটের পুরনো ভবনে তৈরি হয়েছে সংগ্রহশালাটি। যে কক্ষে এই সংগ্রহশালা সেটিও ঐতিহাসিক। এটি ছিল জেলাশাসকের দফতর। সেই বিট্রিশ আমল থেকে। মেদিনীপুর এমনিতেই ঐতিহাসিক শহর। কথিত আছে, এই শহরের পাশ দিয়েই পুরী গিয়েছিলেন শ্রী চৈতন্যদেব। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবও এসেছিলেন। আর স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে তো বিপ্লবের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল মেদিনীপুর। শহরের পুরসভাটিও যথেষ্ট প্রাচীন। ১৮৬৫ সালে গড়ে ওঠে। মেদিনীপুরের যেটুকু ইতিহাস মেলে সেই নথি অনুযায়ী, এক সময়ে শহর ঘেঁষা কাঁসাই নদীতে জাহাজ চলত। জাহাজ মেরামতের এক ভগ্নস্তূপও পরে মিলেছিল নদীর ধারে। শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন মন্দির, মসজিদ। মেদিনীপুরের নাম মিলেছে আইন-ই-আকবরিতেও। ইংরেজ জেলাশাসকদের নামের অনুষঙ্গে শহরের একাধিক এলাকা রয়েছে। যেমন বার্জটাউন, জেলাশাসকের বাংলোও পরিচিত হেস্টিংস হাউস নামে। জেলাশাসকের ভবনটিও ঐতিহাসিক।
সম্প্রতি জেলাশাসকের দফতর কালেক্টরেটের নতুন ভবনে স্থানান্তর হয়েছে। তারপরই ঠিক হয়, পুরনো ভবনের ওই রুমে একটি মিউজিয়াম গড়ে তোলা হবে। যেখানে জেলার ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন ছবি থাকবে। থাকবে জেলার জীববৈচিত্রের কথা। সেই সূত্রেই এসেছে হাতি। চাঁদড়ার বিমল মাহাতোর কথায়, “হাতি কত দেখেছি। মাঝেমধ্যেই ঘরের পাশ দিয়ে হাতির পাল যায়।’’ গোয়ালতোড়ের জঙ্গলে রয়েছে বুনো শুয়োর। এছাড়া ভালুকও পাওয়া যায়। আছে প্রচুর হরিণ। সেসবও ঠাঁই পেয়েছে সংগ্রহশালায়। কিন্তু বাঘ? সেসব তো গল্প বইয়ে মেলে! আর মেলে অবিভক্ত মেদিনীপুরের গাজনের গানে। রয়েছেন ব্যাঘ্রদেবতা বাঘুত। কিন্তু দক্ষিণরায় যে সরাসরি এসে জনজীবন থেকে প্রশাসন পর্যন্ত নড়িয়ে দেবে সে কথা তো ভাবাই যায়নি।
ভাবা তো দূরের কথা। লালগড়ে বাঘ এসেছে বলে মানতে চাননি অনেকে। প্রথমে পায়ের ছাপ মিলল। কেউ বিশ্বাস করেননি। অনেকেই নানা জন্তুর জল্পনা করেছেন। কারও কারও মন্তব্য ছিল, “লালগড়ে বাঘ? ওরম মনে হয়!” বাঘের উপস্থিতি বুঝতে বসানো হল ট্র্যাপ ক্যামেরা। ২ মার্চ বন দফতরের পাতা সেই ট্র্যাপ ক্যামরায় ধরা পড়ে একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘের ছবি। ঝরাপাতার জঙ্গলে রাজকীয় ভঙ্গিমায় ঘুরছে বাঘটি। জানা যায়, বাঘটি রয়্যাল বেঙ্গলই। বিজ্ঞানসম্মত নাম, ‘প্যানথেরা টাইগ্রিস টাইগ্রিস’। তারপরই শুরু হল বাঘাড়ম্বর। বাঘ ধরা বা রক্ষার জন্য টানাপড়েন। কীভাবে মেদিনীপুরে সে এল তার জল্পনা। বাঘ ধরতে কম ফাঁদ পাতা হয়নি জঙ্গলমহলে। খাঁচা পাতা হয়েছিল। শুরুতে ছাগল, পরে শুয়োর রাখা হয়েছিল খাঁচায়। তবে টোপে লোভ দেননি দক্ষিণরায়। বরং কয়েকজনকে জখম করল সে। বাঘ ধরতে গিয়ে গাড়িতে দমবন্ধ হয়ে মারা গেলেন দুই বনকর্মী। শেষে গত ১৩ এপ্রিল চাঁদড়ার জঙ্গলে খুন হয় রয়্যাল বেঙ্গল। একদল শিকারির হাতে তার প্রাণ যায়।
তারপর বাঘ এসে গেল রাজনীতির আঙিনায়। পঞ্চায়েত ভোটেও বাঘ নিয়ে টানাটানি শুরু হল। তাকে নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মেনকা গাঁধীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংঘাতও সামনে এসেছিল। তৃণমূল-বিজেপি বাগাড়ম্বরও চলেছে। নির্বাচনী প্রচারেও উঠে এল বাঘ প্রসঙ্গ! কোথাও বাঘ নির্বাচনী ফেস্টুনে কোথাও দেওয়াল লিখনে। এখন অবশ্য থিতিয়ে গিয়েছে সেই টানাপড়েন। তবে বাঘের আগমনকে স্মরণীয় করতে সংগ্রহশালায় তাকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে।
বিপ্লবীদের শক্ত ঘাঁটি মেদিনীপুরে শার্দুল সম ব্যক্তির আবির্ভাব কম নয়। যেমন হেমচন্দ্র কানুনগো। মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের অস্ত্রগুরু নামে পরিচিত। নারায়ণগড়ের রাধানগরে জন্ম। ক্ষুদিরাম বসু-সহ বিপ্লবীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন ছাত্র। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে হেমচন্দ্র কানুনগোর অবদান অনস্বীকার্য। হেমচন্দ্র কানুনগো সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন জোরদার করতে নিজের খরচে প্যারিস থেকে বোমা বানানোর কৌশল শিখে এসেছিলেন। পরপর তিন জেলাশাসক হত্যা মেদিনীপুরে। ১৯৩১, ১৯৩২ এবং ১৯৩৩ সালে। ’৩১ সালে জেলাশাসক জেমস পেডি খুন হন। পরের বছর জেলাশাসক রর্বাট ডগলাসকে মারা হয়। ’৩৩ সালে খুন হন জেলাশাসক বার্জকে। মারা হয়। সেই ইতিহাসকে যথাযোগ্য মর্যাদায় জায়গা দেওয়া হয়েছে সংগ্রহশালায়। গাঁধীজি এসেছিলেন, নেতাজি এসেছিলেন জেলায়। রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বারোদঘাটনে। আর বিদ্যাসাগরের তো জন্মভূমি। সব ইতিহাসও রক্ষিত হবে সংগ্রহশালায়।
সংগ্রহশালার বিষয়ে উদ্যোগী হন পূর্বতন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা। জেলাশাসকের নির্দেশ মতো মিউজিয়াম গড়ে তোলার পদক্ষেপ শুরু করেন পূর্বতন জেলা উন্নয়ন ও পরিকল্পনা আধিকারিক সুমন্ত রায়। ব্যাটন হাতে নিয়েছেন বর্তমান জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী। জানিয়েছেন, আরও সমৃদ্ধ করা হবে সংগ্রহশালা।
মেদিনীপুর শহর লোকসংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে বিভিন্ন জনজাতির নানা উৎসব, পরব। টুসু পরব, করম পরব। শিকার উত্সব। শিকার উৎসবের সময়েই বাঘটি খুন হয়। বেশ কয়েকটি জায়গাকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে বা তোলার চেষ্টা চলছে। সেইরকমই স্থান মোগলমারি, কুরুমবেড়া দুর্গ, গনগনি জায়গা পেয়েছে। সব কিছুর সঙ্গে ডোরাকাটার মিশেলে সংগ্রহশালা জাঁকাল হয়েছে বলেই মনে করছেন প্রশাসনিক কর্তারা। তাঁদের কথায়, “লালগড়ে বাঘ এসেছিল। এটাও তো এখন একটা ইতিহাস।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy