Advertisement
E-Paper

এ বন্ধুত্বে ধর্মাধর্ম নেই, বর্ণাবর্ণ নেই

শৈলজানন্দ তাঁর আত্মজীবনী ‘কেউ ভোলে কেউ ভোলে না’-তে লিখেছেন, ‘আমি রানিগঞ্জে, নজরুল সিহারসোল রাজার স্কুলে। মাইল দু’য়েকের ছাড়াছড়ি। থার্ড ক্লাসে এসে মিললাম দু’জনে। সেই টানে ধর্মাধর্ম নেই, বর্ণাবর্ণ নেই—সৃষ্টির টান, সাহিত্যের টান’।

কাজী নিজামউদ্দিন

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৫৫
অন্নপূর্ণার মন্দির। ফাইল ছবি

অন্নপূর্ণার মন্দির। ফাইল ছবি

আজ যখন দিকে দিকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, কিছু মানুষ প্রশ্রয় দিচ্ছেন ধর্মান্ধতাকে, তখন এক বন্ধুত্বের কাহিনি শোনাই।

১৯১০-১১ সালে বন্ধুত্ব হয়েছিল রায়সাহেব মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের নাতি শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও চুরুলিয়ার সম্ভ্রান্ত বংশীয়, কিন্তু দরিদ্র পরিবারের সন্তান কাজী নজরুলের। নজরুল চুরুলিয়া ছেড়ে রানিগঞ্জের সিহারসোলের রাজ স্কুলে আর শৈলজানন্দ রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে এলেন। সেখানেই দু’জনের গভীর বন্ধুত্বের সূচনা এবং আমৃত্যু শৈলজানন্দ সেই বন্ধুত্বকে এত সম্মান করতেন, যা অত্যন্ত বিরল ঘটনা।

শৈলজানন্দ তাঁর আত্মজীবনী ‘কেউ ভোলে কেউ ভোলে না’-তে লিখেছেন, ‘আমি রানিগঞ্জে, নজরুল সিহারসোল রাজার স্কুলে। মাইল দু’য়েকের ছাড়াছড়ি। থার্ড ক্লাসে এসে মিললাম দু’জনে। সেই টানে ধর্মাধর্ম নেই, বর্ণাবর্ণ নেই—সৃষ্টির টান, সাহিত্যের টান’। শৈলজানন্দ জন্মগ্রহণ করেন ১৯ মার্চ অন্ডাল গ্রামে। এই গ্রামেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষারও সূচনা। তাঁর মাতামহ রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায়, যাঁর দাদা ছিলেন রায়সাহেব মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এলাকায় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে সবাই রায়সাহেবের দৌহিত্র হিসেবেই জানেন।

কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৮৯৯ সালে। এই দুই ব্যতিক্রমী সাহিত্য প্রতিভা শুধু বর্ধমান জেলাতেই নয়, বাঙালি জাতির কাছে নমস্য। শৈলজানন্দ শুধু সাহিত্যিক নন, প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। তাঁর গল্প ‘ডাক্তার’ থেকে ‘আনন্দ আশ্রম’ সিনেমাটি তৈরি হয়েছে। তিনিই তৈরি করেছিলেন ‘শহর থেকে দূরে’। কয়লাখনি অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তিনিই প্রথম জনসমক্ষে এনেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য দুই সাহিত্যিকই কিশোর বয়স থেকে তাঁদের জীবনের বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন অন্ডাল গ্রামে। এই গ্রামের পুকুরে শৈলজানন্দ নজরুলকে সাঁতার শিখিয়েছিলেন। এক বার তো নজরুল পুকুরে ডুবেই যাচ্ছিলেন, রায়সাহেবের সহিস মহবুব তাঁকে উদ্ধার করেন। শোনা যায়, এখানে বেশ কয়েকটি গান লিখেছিলেন নজরুল। যে ঘরে দুই বন্ধু নজরুল ও শৈলজানন্দ দিনের পরে দিন থাকতেন, সেই ঘর এখনও ভাঙা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। রয়েছে রায়সাহেব প্রতিষ্ঠিত অন্নপূর্ণা মন্দির, অন্ডাল গ্রাম হাইস্কুল, যে স্কুলে শৈলজানন্দ পড়তেন। তখন ছিল এমভি স্কুল।

নজরুল ও শৈলজানন্দের এই গভীর এবং অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, এমনকী, সমগ্র ভারতবর্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক দৃষ্টান্ত। নজরুলের সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে শৈলজানন্দ সারাজীবন প্রশংসা করেছেন। শৈলজানন্দ নজরুলকে নিয়ে দু’-দুটি বই লিখেছেন। রানিগঞ্জ ছেড়ে আসার পরে যখন তাঁরা কলকাতায় মেসে থাকতেন, তখনও সেই সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়নি। এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া ও ভবঘুরে জীবনের আনন্দ উপভোগ করেছেন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। নজরুলের অসুস্থতার পরেও শৈলজানন্দ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

দুঃখের বিষয়, মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক এই দুই মনীষীর স্মৃতিবিজড়িত কর্মকাণ্ড আজও আমাদের অজানা। নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের একটা বড় অংশ এঁদের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না। অনেকে এ বিষয়ে উদাসীন। ‘আমার বন্ধু নজরুল’ গ্রন্থে শৈলজানন্দ নজরুলের মহান অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও তাঁর ঔদার্য্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন—‘হাওয়ায় ওড়ে সাদা কাশের ফুল, আর দূরে হয়তো কোন্ ঘুঘু ডাকা প্রান্তরের পারে ছোট্ট একটা মাটির ঘরের ভিতরে বসে সুর করে মহাভারত পড়ে, রামায়ণ গান করে, দরিদ্র এক মুসলমানের ছেলে দুখু মিঞা, আর হিন্দু মেয়েরা হাত জোড় করে শোনে সেই মহাকাব্যের কীর্তিকাহিনী’।

এই দুই বন্ধু স্বীয় সৃজন ক্ষেত্রে নক্ষত্র। কিন্তু তাঁদের যোগসূত্র মানবপ্রেম। সে মানবপ্রেম সংকীর্ণ জাতপাতের ভেদাভেদের অনেক উপরে। শৈলজানন্দ বলতেন, মানুষকে ভালবেসেই তাঁর সাহিত্যের অঙ্গনে আগমন। আর, নজরুল তো বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।

অন্ডাল গ্রামকে আমরা মৈত্রী ও সম্প্রীতির পীঠস্থান হিসেবে গড়ে তুলতেই পারি। এখানেই এই দুই মনীষীর জন্মদিন, সাহিত্যকর্ম ও চলচ্চিত্র নিয়ে তৈরি হোক শৈলজানন্দ-কাজী নজরুল স্মারক, একটি মিউজিয়াম।

আসানসোল-দুর্গাপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এডিডিএ), ডিভিসি কর্তৃপক্ষ, পশ্চিম বর্ধমান জেলা প্রশাসন ও কয়লাখনিগুলির কর্তা-ব্যক্তিগণ বাঙালির এই হারানো ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসুন। নজরুল, শৈলজানন্দ আমাদের প্রাণের মানুষ। আর অন্ডাল গ্রাম তাঁদের চরণস্পর্শে ধন্য। তাঁদের কাছে বাঙালির অনেক ঋণ। আজ সময় এসেছে সেই ঋণ শোধ করার।

লেখক বিজড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক

Friendship Sailajanand Mukherji Kazi Nazrul Islam শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কাজী নজরুল ইসলাম Communal Harmony Religion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy