E-Paper

বাংলায় কথা বলা কি অপরাধ, প্রশ্নই সম্বল

কেন্দ্রের শাসক দলের তথ্যপ্রযুক্তি শাখার সর্বজ্ঞ মুখিয়া নিদান দেন, বাংলা বলে প্রকৃতপক্ষে কোনও ভাষা নেই।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:২২
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

চলমান শতাব্দীর সিকি ভাগ ফুরিয়ে গেল। আধুনিকতায় মোড়া এবং প্রযুক্তিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এই অগ্রগতির পথে এই শতকের পঁচিশটি শীত পেরোতে পেরোতে আয়নার সামনে দাঁড়াতে হল বাঙালিকে! প্রতিবিম্ব যেখানে প্রশ্ন তোলে, আমরা কি বাঙালি? বাঙালি হওয়া কি এখন অপরাধ?

বছর শেষে প্রাপ্তি এবং ক্ষতির হিসেব কষতে বসা প্রতি বারের দস্তুর। তবে কিছু পাওয়া বা হারানোর কেজো লেখা-জোখায় এই অপসৃয়মান বছরের ছবি আসলে ধরা পড়ে না! কারণ, এই ২০২৫ সেই মোক্ষম প্রশ্নই বারবার সামনে এনে দিয়ে গিয়েছে যে, বাংলায় কথা বলা কি অন্যায়? বাংলাভাষী হলেই কি এই দেশে ‘অনুপ্রবেশকারী’ কি না সন্দেহ নিয়ে বাঁচতে হয়?

এই বছরটা সেই বছর, যখন দিল্লি পুলিশ দেশের রাজধানীর উপকণ্ঠে বস্তিতে থাকা কিছু খেটে-খাওয়া মানুষকে আটক করে বঙ্গ ভবনে চিঠি পাঠিয়ে পশ্চিমঙ্গের সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে ‘বাংলাদেশি ভাষা’য় লেখা নথির অনুবাদে সাহায্য চায়! কেন্দ্রের শাসক দলের তথ্যপ্রযুক্তি শাখার সর্বজ্ঞ মুখিয়া নিদান দেন, বাংলা বলে প্রকৃতপক্ষে কোনও ভাষা নেই। এই বছরটা সেই বছর, যখন সেই দিল্লি পুলিশের হাতে ধরা পড়া, অন্তঃসত্ত্বা সুনালী খাতুনকে তাঁর শিশুপুত্র ও স্বামী-সমেত বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করে দেওয়া হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দেওয়ার পরেও রাষ্ট্রীয় শাসকেরা তাঁকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হন না। শেষমেশ বাংলাদেশের আদালতে লড়াই করে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁকে বীরভূমে স্বগৃহে ফিরতে হয়। এবং ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) দৌলতে ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় যখন সুনালীর বাবা ভোদু শেখের নাম পাওয়া যায়, তাতেও ‘অনুপ্রবেশকারী’র তকমা দেওয়া শাসকের কোনও হেলদোল হয় না! এই বছরটা সেই বছর, যখন পাশের রাজ্য ওড়িশায় কাজ করতে গিয়ে বাংলায় কথা বলে বিপাকে পড়ে এবং প্রহারের জেরে কফিনবন্দি হয়ে মুর্শিদাবাদের বাড়িতে ফিরতে হয় পরিযায়ী শ্রমিক জুয়েল রানাকে।

সুনালী থেকে জুয়েল, তালিকা দীর্ঘ। নানা রাজ্যে আক্রান্ত বাংলাভাষী শ্রমিকদের সেই তালিকা বাড়তেই থেকেছে বছরভর। আক্রমণের শিকার মূলত স্বল্পবিত্ত এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, খেটে-খাওয়া মানুষ। সে সব ঘটনা পরপর সাজালেই বোঝা যায়, বছরটা বাঙালির জন্য কেমন গিয়েছে! প্রতিবাদ হয়েছে রাজ্য জুড়ে। রাজ্যের বাইরে আক্রমণ তাতে বন্ধ হয়নি। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজের ঘরে ফিরে এসে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ভিন্ রাজ্যে বাড়তি রোজগারের পথ ছেড়ে ঘরমুখী হওয়ার উৎসাহ বিশেষ চোখে পড়েনি।

কেমন আশ্চর্য সমাপতন, ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর তুখোড় গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায় এই বছরেরই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। ও’পার বাংলার মানুষ অঞ্চলভেদে যে সব লব্জ ব্যবহার করেন বা যেমন উচ্চারণ করেন, সেগুলো আসলে বাংলা নয়। ওই উচ্চারণ শুনেই মুসলিম এবং অনুপ্রবেশকারী চেনা যায়— এ সব যুক্তির বাহার প্রতুলকে আর শুনতে হয়নি! যেমন প্রয়াত আজিজুল হক বা প্রফুল্ল রায়কেও দেখতে হয়নি, ওই একই উচ্চারণের বাংলাভাষী দীপু দাস, অমৃত মণ্ডলেরা বাংলাদেশে মৌলবাদীদের হাতে খুন হলে এ’পারে হিন্দু খুন টগবগ করে ফোটে! উচ্চারণের তফাত পবিত্র ক্রোধে কোনও বাধা হয় না। জুয়েলদের জন্য হয়। আবার এই বঙ্গে ওয়াকফ-প্রতিবাদের নামে হরগোবিন্দ দাস, চন্দন দাসকে নৃশংস ভাবে খুন করা হলে এক দল তেড়েফুঁড়ে প্রতিবাদ করে, অন্য অংশ থাকে উদাসীন। মুর্শিদাবাদে কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দা ইজাজ আহমেদ শেখ পুলিশের গুলিতে মারা গেলে (পরিবারের দাবি, গোলমালে তার কোনও যোগ ছিল না) বা এক পাড়ায় দলে দলে লোক আচমকা গুলিতে জখম হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকলে কোনও প্রতিক্রিয়াই হয় না। সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশে নির্যাতিত হলে সেটা অন্যায়, এ দেশে হলে ওরা ‘গুন্ডা’— এই সামাজিক বোধ আরও চেপে বসার বছর এই ২০২৫!

বাংলাদেশের কথা এলে অবশ্যই মনে করতে হয় সনজিদা খাতুনের কথা। রবীন্দ্র অনুরাগিণী সনজিদা ভৌগোলিক বেড়া পেরিয়ে এ’পারেও ছিলেন কাছের মানুষ। তাঁর চোখ বোজার বছরটিতে সনজিদার প্রাণাধিক প্রিয় ঢাকার ‘ছায়ানট’-এ যে-তাণ্ডব সে দেশের মৌলবাদীরা চালিয়েছে, সে লজ্জাও সীমানা ছাড়িয়ে আপামর বাঙালির।

চলে যাওয়া বছরে হারাতে হয়েছে রজতকাম্ত রায়, স্বপ্না দেব, জ্যোতির্ময় দত্ত, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়, বিগত জমানার দাপুটে মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা, উপেন কিস্কুদের। হারানোর পাশাপাশি উজ্জ্বল হয়ে থেকেছেন কিছু বাঙালি সন্তান। অধুনা রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান পুরস্কারের অন্তর্গত শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তরুণ গবেষক দিব্যেন্দু দাস, দেবার্ক সেনগুপ্ত, অর্কপ্রভ বসু, সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়েরা। এঁদের মধ্যে রসায়নের দিব্যেন্দুর কর্মক্ষেত্র কলকাতাই। বাকিরা প্রবাসে। এঁরা যেমন নীরবে নিভৃতে জ্ঞানচর্চায় মগ্ন, তেমনই আবার খেলার ময়দানে বাংলার জন্য গৌরব নিয়ে এসেছেন রিচা ঘোষ। মহিলাদের ক্রিকেটে আগেই প্রতিষ্ঠিত, এ বার ভারতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ হাতে তুলেছেন শিলিগুড়ির কন্যা।

ব্যক্তিগত সাফল্য বা কৃতিত্বের খতিয়ান সরিয়ে রাখলে দু’টো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। কলকাতায় পুজোর মুখে আকাশভাঙা বৃষ্টির পরে জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন ১০ জন। পুজোর ঠিক পরেই পাহাড়ে বিপর্যয়ে প্রাণ গিয়েছে অন্তত ২৮ জনের। প্রকৃতি বনাম উন্নয়নের শাশ্বত বিতর্ক ফের সামনে এসেছে।

তবে এই সব কিছুর পরে পশ্চিমবঙ্গে এই বছরের সব চেয়ে বড় ঘটনা নিঃসন্দেহে এসআইআর। ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটা যাওয়ার ‘আতঙ্কে’ ৫০-এর বেশি মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। অন্তত পাঁচ জন বুথ লেভল অফিসারের (বিএলও) আত্মহত্যার অভিযোগ ঘিরেও বিতর্ক। প্রতি বছর ভোটার তালিকার নিয়মিত সংশোধনের সময়ে মৃত বা স্থানান্তরিত ব্যক্তিদের নাম কেন বাদ যায় না, সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। পশ্চিমবঙ্গে কোটিখানেক অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গা ঢুকে বসে আছে, বিজেপির এই প্রচারের বিপরীতে চলছে তৃণমূল কংগ্রেসের ‘জোয়ান, বুড়ো, মহিলা, মতুয়া সকলের নাম কেটে দেবে’র পাল্টা রব। দু’টোই উচ্চকিত। মাঝে ভুগছেন সাধারণ মানুষ।

নতুন বছরে এই রাজ্য ফের বিধানসভা নির্বাচনের মুখোমুখি হবে। ভোটের অঙ্ক মাথায় রেখে রাষ্ট্র বা রাজ্যের প্রধানদের মুখে বাঙালি মনীষীদের নাম বারংবার আসবে। সুনালী, জুয়েলদের যা বয়ে বেড়াতে হয়েছে, সে গ্লানি মিটবে কি?

পদ্মশ্রী অরিজিৎ সিংহ গোকুলচন্দ্র দাস মমতা শঙ্কর নগেন্দ্রনাথ রায় পবন গোয়েন্‌কা সজ্জন ভজন্‌কা স্বামী প্রদীপ্তানন্দ (কার্তিক মহারাজ) তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার বিনায়ক লোহানি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Language

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy