হবু ডাক্তারদের নিয়ে কথা বলতে গেলে বর্ষীয়ান চিকিৎসকদেরই অনেকে বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে অসুস্থ হলে কোন ভরসায় এঁদের কাছে গিয়ে দাঁড়াব?’’
কেন এমন সংশয়? ওই চিকিৎসকদের যুক্তি, ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং-ই হল চিকিৎসক হিসেবে গড়ে ওঠার প্রাথমিক শর্ত। বই পড়ে নয়, রোগীর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষক বোঝাবেন অসুখের খুঁটিনাটি, আর হাতেকলমে তা শিখবেন পড়ুয়ারা। এমনই হয়ে এসেছে। এমনই হওয়ার কথা। অথচ এ রাজ্যে এই ক্লিনিকাল বা বেডসাইড ট্রেনিং-ই এখন তলানিতে। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গিয়েছে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেখানে ক্লিনিকাল ট্রেনিং হয় না।
কেন হয় না? মেডিক্যাল শিক্ষার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের বড় অংশ জানাচ্ছেন, যে হারে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে আসন বাড়ছে, তাতে শিক্ষক-পড়ুয়া কোনও পক্ষেই এ নিয়ে বিশেষ উৎসাহ নেই। কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের এক পড়ুয়া বলেন, ‘‘আমাদের কলেজে ২৫০টা আসন। এক-একটা দলে ৩৫-৪০ জনকে নিয়ে স্যর বা ম্যামরা ওয়ার্ডে যান। সেখানে এক-একটা শয্যায় দুই থেকে তিন জন রোগী। মেঝেতে তাঁদের বাড়ির লোকেরা। বেডের
পাশে দাঁড়িয়ে রোগীকে পরীক্ষা করা তো দূর, অনেকে রোগীর মুখটুকুও দেখতে পাই না। তা হলে সময় নষ্ট করে যাব কেন?’’
অতএব যাওয়া হয় না। রোগীকে ছুঁয়ে না দেখেই দিব্যি পাশ করে বেরিয়ে যান ডাক্তাররা। এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-চিকিৎসকের কথায়, ‘‘রোগীকে ছুঁয়ে দেখে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা হয় না বলেই গুচ্ছের পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে হয়। কী ভাবে রোগী বা তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তা ছাত্রাবস্থাতেই শেখার কথা। এখন সেই পরিস্থিতি তৈরি হয় না। তা থেকেই যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত।’’
কী বলছেন শিক্ষকেরা? মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের কথায়, ‘‘সব কেটেকুটে ৬০ হাজার টাকার মতো পাই। অর্থাৎ দৈনিক দু’হাজার টাকা। তার জন্য আমাকে কী করতে হয়? ইমার্জেন্সি, আউটডোর, ওয়ার্ড, অপারেশন এবং তার সঙ্গে ক্লাস নেওয়া। অন্য দিকে, প্রাইভেটে এক জন খুব সাধারণ মানের ডাক্তারেরও এখন অন্তত ৪০০ টাকা ফি। তিনি যদি সারা দিনে ১০ জন রোগীকে দেখেন, তা হলেও তাঁর দৈনিক ৪০০০ টাকা আয় হবে। যা বাজার পড়েছে, তাতে সরকারকেও এটা ভাবতে হবে। না হলে শিক্ষকদের গয়ংগচ্ছ মনোভাব নিয়ে দোষারোপ করে লাভ হবে না।’’
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার স্বীকারোক্তি, ‘‘অন্য একাধিক রাজ্যে চিকিৎসকদের যা বেতন, এখানে প্রায় তার অর্ধেক। পদোন্নতি আটকে থাকে বছরের পর বছর। ফলে কাজে উৎসাহ হারান অনেকেই। সরকারি চাকরিতে নাম লিখিয়েও প্রাইভেট প্র্যাক্টিসেই সময় দেন।’’
বিভিন্ন জেলার মেডিক্যাল কলেজে ঘুরে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষক-চিকিৎসকেরা সপ্তাহে দু’-তিন দিনের বেশি থাকেন না। কারণ, তাঁদের বড় অংশ অন্য জেলার বা কলকাতার। নিয়মরক্ষার দু’তিনটে দিন কাটিয়ে বাকি সময় তাঁরা থাকেন ‘হোম সেন্টারে’। সেখানকার চেম্বারে পসার বেশি। তবে জেলায়ও তাঁদের চেম্বার আছে। দুপুরের পরে হাসপাতালের বদলে তাঁদের চেম্বারেই দেখা যায় বেশি।
বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির হাল আরও খারাপ। সেখানে নিয়মিত ক্লাস হওয়াই আশ্চর্যের। সকলেই জানেন, যে শিক্ষকদের নাম ওই সব কলেজের তালিকায় থাকে, তাঁদের অনেকেই বছরে হাতে গোনা কয়েকটা দিন যান। তাঁদের সঙ্গে সে রকমই চুক্তি কলেজ কর্তৃপক্ষের। মূল শর্ত, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিরা যখন পরিদর্শনে আসবেন, তখন যেন তাঁরা হাজির থেকে উতরে দেন। মেদিনীপুরের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে সপ্তাহের শুরুতে একটি দিনে খোঁজ করে দেখা গেল, শিক্ষক এবং পড়ুয়ার যে ঘোষিত সংখ্যা, তার ২৫ শতাংশও হাজির নেই। এক কর্তা স্বীকার করলেন, এটাই ‘দস্তুর’। এমসিআই নামক জুজুর ভয়ে বছরে কয়েকটা দিন ঠিকঠাক হাজিরা থাকে। বাকি সময় যে যার নিজের মতো।
আর শিক্ষক কোথায় মিলবে? সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিই শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে, অবসরের বয়স বাড়িয়েও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, সেখানে বেসরকারি কলেজগুলি কোন জাদুমন্ত্রে শিক্ষকের বন্দোবস্ত করবে? ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে। মোটা টাকা খরচ করে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়তে পাঠাচ্ছেন বাবা-মায়েরা। কোথাও কোথাও ভর্তি এবং আনুষঙ্গিক খরচ এক কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। খরচ করা টাকা দ্রুত উসুল করার চাপ থাকছে। প্রাইভেট টিউশনে ভর করে বৈতরণী পেরনো ডাক্তাররা পরবর্তী সময়ে চেম্বার খুলে বসছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের শিক্ষা কতটা সম্পূর্ণ হচ্ছে, সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমার নিজের অভিজ্ঞতাতেই দেখছি, অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে নতুন ডাক্তারেরা কাজ করতে পারছেন না। আসলে এঁরা রোগীকে ছুঁয়ে দেখে নয়, শুধু বই পড়া বিদ্যায় রিপোর্ট দেখে চিকিৎসা করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। মেডিকো লিগাল কেসের সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছে, তাতে ওঁদের খুব একটা দোষ দেওয়াও যায় না।’’
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র অবশ্য দাবি করেছেন, কী ভাবে মেডিক্যাল শিক্ষার মান উন্নত করা যায়, সে নিয়ে নিরন্তর ভাবনাচিন্তা চলছে স্বাস্থ্য প্রশাসনের।
শিক্ষার মান নিয়ে এই সংশয়ের কথা অস্বীকার করছেন না বর্তমান শিক্ষক-চিকিৎসকেরাও। এসএসকেএম হাসপাতালের শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, এমবিবিএস স্তরে পঠনপাঠনের মান উন্নত করতে সেখানে সম্প্রতি একটি কমিটিও তৈরি হয়েছে। পঠনপাঠনের সমস্যার ক্ষেত্রে হাউসস্টাফশিপ বাধ্যতামূলক না থাকাকে অনেকাংশে দায়ী করেছেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের রেডিয়োথেরাপি বিভাগের প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, শুধু হাউসস্টাফশিপ নয়, ইন্টার্নশিপের সময়েও ইদানীং কারও কারও নিয়মিত হাজির থাকতে অনীহা দেখা যাচ্ছে। এই প্রবণতা মারাত্মক।
প্রশ্ন হল, এ ক্ষেত্রে উত্তরণের পথটা কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy