পুরসভার এই ফলে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান এমনই নিরঙ্কুশ ও বিস্তর যে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানাধিকারীরা রয়ে গিয়েছে বহু পিছনে! খাতায়-কলমে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এ বারের পুরভোটেও ফের বিধ্বস্ত।
তমলুকে তৃণমূলের বিজয় মিছিল। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস
পুরভোটে রাজ্য জুড়ে প্রকৃত অর্থেই শাসক দলের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল। পশ্চিম থেকে পূর্বে, উত্তর থেকে দক্ষিণে সবুজ ঝড় তুলে একাই একশোর বেশি পুরসভা জিতে নিল তৃণমূল কংগ্রেস। এক ধাক্কায় ৩৩টি পুরসভা একেবারেই বিরোধীশূন্য!
পুরসভার এই ফলে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান এমনই নিরঙ্কুশ ও বিস্তর যে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানাধিকারীরা রয়ে গিয়েছে বহু পিছনে! খাতায়-কলমে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এ বারের পুরভোটেও ফের বিধ্বস্ত। তুলনায় বিরোধী পরিসরে বামেদের চেহারা সামান্য হলেও চোখে পড়ছে। শিবরাত্রির সলতের মতো একটি পুরসভায় জয়ীও হয়েছে বামেরা। আর ওয়ার্ড-সংখ্যার নিরিখে দেখলে তৃণমূলের পরে দ্বিতীয় স্থানে আছেন নির্দলেরা! যাঁদের অধিকাংশই শাসক দলের ‘বিক্ষুব্ধ’।
রাজ্যের ২০টি জেলায় ছড়িয়ে থাকা ১০৮টি পুরসভার মধ্যে এ যাত্রায় ১০২টিই চলে এসেছে তৃণমূলের দখলে। তার মধ্যে দিনহাটা ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিল তারা। ভোট-গ্রহণের পরে বুধবার যে ১০৭টি পুরসভার গণনা হয়েছে, তার মধ্যে ১০১টি গিয়েছে শাসক দলের দখলে। নদিয়ার তাহেরপুর ধরে রাখতে পেরেছে বামফ্রন্ট। পাহাড়ে দার্জিলিং পুরসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে নবগঠিত ‘হামরো পার্টি’। আর মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, পুরুলিয়ার ঝালদা, পূর্ব মেদিনাপুরের এগরা এবং হুগলির চাঁপদানি পুরসভার ফল ত্রিশঙ্কু। টানা কয়েক দশক ধরে পূর্ব মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবারের ‘গড়’ কাঁথি বা কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীর খাস তালুক বহরমপুরও এ বার চলে এসেছে তৃণমূলের খাতায়। বহু বছর ধরে কংগ্রেসের কাছে থাকা জয়নগর-মজিলপুর পুরসভাও ‘হাতছাড়া’ হয়ে তৃণমূলের ঝুলিতে। গত বছরের বিধানসভা নির্বাচন থেকে যে প্রবণতা চলছে, কয়েকটি উপনির্বাচন, তার পরে পাঁচটি পুর-নিগম এবং এখন পুরভোটে তা যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, এই প্রেক্ষিতেই আগামী বছর রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে চলেছে। তার পরের বছর লোকসভা ভোট। এই প্রবণতা বজায় থাকলে রাজ্যের রাজনৈতিক চিত্র কেমন দাঁড়াবে, তার হিসেব-নিকেশ শুরু করে দিয়েছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
বিরোধীরা অবশ্য পুরসভার এই ফলকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, ভোট লুঠ করে নির্বাচনের দিন যে ‘প্রহসন’ হয়েছিল, তখনই ফল কেমন হবে, বোঝা যাচ্ছিল। তাই এই ফলাফলকে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন বলে ধরতে রাজি নন বিরোধী নেতারা। তাঁরা বরং কটাক্ষ করছেন, এত কিছুর পরেও ১০৮-এ ১০৮ পুরবোর্ড শাসক দলের দখলে গেল না কেন!
তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছাপ্পা ও জালিয়াতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলপ্রকাশের পরে এ দিন উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটের প্রচারে বারাণসী যাওয়ার পথে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘কোথাও কিছু ঘটেনি। মানুষ উৎসবের মেজাজে ভোট দিয়েছেন। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে অপপ্রচার হয়েছে। মোট ১১ হাজার ২০০ বুথে ভোট হয়েছে। অভিযোগ ছিল ৭টায়। দু’টি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছে।’’ দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি তাঁর বার্তা, ‘‘যত জয়ী হব, তত বিনয়ী হব। নম্র হতে হবে। পুরভোটের এই জয় আমাদের দায়িত্ব ও নিষ্ঠা বাড়াক। সকলে মিলে শান্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।’’ ফল প্রকাশের পরে টুইট-বার্তাতেও মমতা বিনয়ের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন।
বিধানসভা ভোটে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এলেও কলকাতা পুরসভার ভোট থেকেই জমি হারাতে শুরু করেছিল বিজেপি। হারানো জমি খানিকটা হলেও বামেদের ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছিল কলকাতায়। আসানসোল, বিধাননগর-সহ আরও চারটি পুর-নিগমের নির্বাচনেও একই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। এ বার ১০৮টি পুরসভার ভোটেও সেই প্রবণতাই বজায় রয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ভোট হয়েছিল ২১৭১টি ওয়ার্ডে। ফল ঘোষণা হয়েছে ২১৭০টির। তার মধ্যে তৃণমূল জয়ী হয়েছে ১৮৭০টি ওয়ার্ডে। তাদের প্রাপ্ত ভোট ৬৩.৫%। ওয়ার্ড-জয়ের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে বিজেপিই। তারা জিতেছে ৬৩টি ওয়ার্ডে। কিন্তু পুরসভা জয় এবং ভোট-প্রাপ্তির বিচারে গেরুয়া শিবিরকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বামেরা। তারা জয়ী হয়েছে ৫৬টি ওয়ার্ডে এবং ভোট পেয়েছে ১৪.১৪%। কংগ্রেস ৫৯টি ওয়ার্ডে জয় পেয়েছে, তাদের প্রাপ্ত ভোট ৪.৮%। অর্থাৎ তৃণমূলের বিপুল ঝড়ের মধ্যেও বাম ও কংগ্রেস মিলে প্রায় ২০% ভোট পেয়েছে। অধিকাংশ পুরসভাতেই দু’পক্ষ অবশ্য আলাদাই লড়েছিল, সমঝোতা হয়েছিল হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায়। কমিশনের তথ্য বলছে, নির্দল প্রার্থীরা ১১৯টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন এবং ভোট পেয়েছেন ৪.৯%। ভোটের আগে নির্দলদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছিল তৃণমূল। ভোটের পরে এখন তাঁদের দলে ফেরানো হবে কি না, সেই ব্যাপারে দলে আলোচনা হবে বলে এ দিন জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
পুরভোটের এই ফলাফলকে ‘গ্রহণ’ না করার কথাই বলছেন বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘ভোটের নামে যে প্রহসন হয়েছে, তার ফল আমরা মানছি না। ভোটের দিনের মতো আজও দুর্বৃত্তেরা তাদের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, অশ্লীল গান, অঙ্গভঙ্গি করছে। আর মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, মা-মাটি-মানুষের জয়। এর মধ্যে মা-মাটি-মানুষ কিছুই নেই! বিজেপি আগামী দিনেও রাস্তায় থাকবে।’’ কিন্তু যে ভোটের ফল তাঁরা মানছেন না, সেখানে তো বিজেপিরও বেশ কিছু প্রার্থী জিতেছেন। তাঁদের কি দল কাউন্সিলর পদ ছেড়ে দিতে বলবে? রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের জবাব, ‘‘আমরা চাই, পুরো ভোট বাতিল করে নতুন করে ভোট হোক। আমরা আদালতে গিয়েছি। আদালতের রায় আমাদের পক্ষে গেলে এমনিতেই আমাদের জয়ী প্রার্থীদেরও জয় বাতিল হবে। আর মামলায় আমরা না জিতলে আমাদের কাউন্সিলরদের পদত্যাগ করতে বলা হবে কি না, তা তখন দল সিদ্ধান্ত নেবে।’’
দিল্লিতে তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র সুখেন্দুশেখর রায় পাল্টা কটাক্ষ করেছেন, ‘‘বিজেপির তিন নেতা শুভেন্দু অধিকারী, অর্জুন সিংহ, সুকান্ত মজুমদার নিজেদের গড়েই গড়াগড়ি খাচ্ছেন! তাঁরা হিংসায় উস্কানি দেওয়ার চেষ্টার চেষ্টা করেছেন।’’ শুভেন্দু প্রসঙ্গে সুখেন্দুর দাবি, উনি যে ‘কাগুজে বাঘ’, তা এখন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে!
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, ‘‘এই নির্বাচনে খেলার মাঠ, কোন বলে খেলা হবে, কারা দর্শক থাকবেন, সব ঠিক করেছে শাসক দল। রেফারিও তাদের! তার পরেও ১০৮ হল না! কিছু আসনে শাসক দল হেরে গেল? ওই সব জায়গায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও পুলিশ-প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত!’’
মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘বিধানসভা ভোটে যা ফল হয়েছিল, তার পরে এখন আপনার হেরে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি। আপনি জিতবেন, আমরা জানতাম। কিন্তু আপনার ভরসা নেই মানুষের উপরে! মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে বাংলার গণতন্ত্রকে নতুন করে কলঙ্কিত করলেন।’’ এখন আর কারও কোনও গড় নেই, সবই ‘দিদির গড়’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy