বাঙালির সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপনে বক্তৃতায় ‘কালী’ ও ‘দুর্গা’র নামে জয়ধ্বনি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভোট-মুখী রাজ্যে তার জবাবে হিসেবের খাতাই সামনে রাখল তৃণমূল কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি ও রাজনৈতিক সভার পরে শুক্রবার তৃণমূলের তরফে বলা হল, অদৃশ্য সাড়ে পাঁচ হাজার কোটির প্রকল্প উদ্বোধনের কথা বললেও রাজ্যেরা বকেয়া প্রাপ্য নিয়ে মুখ খোলেননি তিনি। রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ও শাসক দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদকের প্রশ্ন, ‘‘আপনি (প্রধানমন্ত্রী) খালি হাতে এলেন কেন?’’ সেই সঙ্গেই ‘জয় শ্রীরাম’-এর বদলে কালী ও দুর্গার নাম করায় তৃণমূলের কটাক্ষ, বাংলায় ‘পরিবর্তন’ হবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ‘পরিবর্তন’ করে ফেলেছেন!
রাজ্যে বিধানসভা ভোটের বাকি এখনও আট- দশ মাস। তবু সেই ভোটের কথা মাথায় রেখেই দুই প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল ও বিজেপি পরস্পরের ময়দান তৈরি করে নেমে পড়েছে। দুর্গাপুরে এ দিন জোড়া সভায় দুর্নীতি, তোষণ ও অনুন্নয়নের অভিযোগে রাজ্যের শাসক তৃণমূলকে বিঁধেছেন প্রধানমন্ত্রী। কলকাতায় তৃণমূলের তরফে রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য প্রধানমন্ত্রীর ‘আসল পরিবর্তন’-এর স্লোগান খারিজ করে বলেছেন, ‘‘২০১১, ১৬ আর ২১-এর মতো এ বারও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সরকার গড়বেন।’’ আর কুণাল বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মিথ্যাচার করে গিয়েছেন। বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত ১১ বছরে মাত্র ২২ লক্ষ চাকরি হয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘বাংলার প্রাপ্য এক লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা দেন না। ১০০ দিনের সেই টাকা, আবাস প্রকল্পের টাকা এ সব তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দিয়েছে।’’
বাংলাভাষী ও বাংলাদেশি বিতর্ক নিয়েও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিকে কাঠগড়ায় তুলেছে তৃণমূল। চন্দ্রিমা বলেন, ‘‘বাঙালিদের না কি খুব শ্রদ্ধা করেন! ডাবল ইঞ্জিন সরকারগুলি বাংলাভাষীদের বিতারিত করার রাস্তা করছে। তা নিয়ে তো আপনি একটি কথাও বললেন না।’’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার বাংলা ভাষা নিয়ে চন্দ্রিমার মন্তব্য, ‘‘বোধহয় চাপটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছে। কিন্তু ডাবল ইঞ্জিন সরকার তো বাংলাভাষীদের রোহিঙ্গা বলে চিহ্নিত করছে।’’ এই প্রসঙ্গে অসমের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আর কুণালের প্রশ্ন, ‘‘বাংলা সম্পর্কে এত ভালবাসা থাকলে ১১ বছরে এক জনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পূর্ণমন্ত্রিত্ব পেলেন না কেন?’’
প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রেক্ষিতে পাল্টা সরব হয়েছে সিপিএম ও কংগ্রেসও। মোদী যে ‘বাঙালি অস্মিতা’র প্রসঙ্গ এনেছেন, তা নিয়ে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর প্রশ্ন, ‘‘বাঙালি অস্মিতার কথা, ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। খুব ভাল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কি শুধু ভোট এলেই নামগুলি মনে পড়ে? অন্য সময়ে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী মানুষকে হেনস্থা করা হচ্ছে যখন, তখন এই সব নামগুলি কি প্রধানমন্ত্রীর মুখে আনা ঠিক? বিজেপি আসলে বাংলা, বাংলার সংস্কৃতির বিরোধী।” শিক্ষা-দুর্নীতি নিয়েও এ দিন রাজ্যকে বিঁধেছেন মোদী। সেই সূত্রে সুজন বলেছেন, “শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চাইছে রাজ্য সরকার। কিন্তু সিবিআই, ইডি এত দিন ধরে কী করছে? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পরে আর মাথার দিকে যাওয়া হল না। দিল্লিওয়ালারা কি সিবিআই-ইডি’কে আটকাচ্ছেন? এটাই কি বলা হয়েছে যে, তদন্ত করে দোষীদের খুঁজে বার করবে না। কারণ, উত্তরপ্রদেশে ব্যপম কেলেঙ্কারি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আর কী করবেন, উনি তো ব্যপমের পাশে!”
মোদীকে এক ডজ়ন প্রশ্নে বিদ্ধ করেছে কংগ্রেসও। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি বাংলার বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে সুবিচার দিতে কেন ব্যর্থ, বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের হেনস্থা হচ্ছে কেন, এমন ১২টি প্রশ্ন তুলেছে তারা। এর সঙ্গেই বিজেপি-তৃণমূল ‘আঁতাঁতে’র তত্ত্বেও শাণ দিয়েছে কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারের বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রীর হাতে সিবিআই, ইডি থাকলেও রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতির এখনও কেন কিনারা হয়নি? কেন সিবিআইয়ের অপদার্থতার জন্য আর জি কর-কাণ্ডের নির্যাতিতার পরিবার এখনও সুবিচার পায়নি? ভোট এলে মোদীর বাংলার প্রতি দরদ উথলে ওঠে! কিন্তু বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষীদের হেনস্থা করা হলেও তিনি রাজধর্ম পালন করেন না।” তাঁর সংযোজন, “দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তৃণমূলের কেউ এখনও শাস্তি পাননি। বরং সিবিআই, ইডি ওই সব দুর্নীতি আড়াল করতে সচেষ্ট।’’
রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একাধিক প্রশ্ন তুলেছেন। আর জি কর হাসপাতালের চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার উল্লেখ করেছেন তিনি। সেই প্রশ্নে তৃণমূলও পাল্টা বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির প্রসঙ্গ টেনেছে। কুণালের কথায়, ‘‘আর জি কর-কাণ্ডে কলকাতা পুলিশ যা করেছে, আপনার (প্রধানমন্ত্রী) সিবিআই তাতেই সিলমোহর দিয়েছে। কিন্তু ওড়িশায় ক্যাম্পাসে নিগ্রহের বিচার না পেয়ে আত্মঘাতী ছাত্রীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনও কথা বলেননি। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তা নিয়ে আপনি চুপ!’’ অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যে কঠোর মনোভাব জানিয়েছেন, তার জবাবে কুণালের মন্তব্য, ‘‘আত্মঘাতী গোল করেছেন তিনি। এর জন্য নিজের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি চাওয়া উচিত ওঁর!’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)