Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
আতঙ্কের অস্ত্র সন্ত্রাস

প্রতিরোধের ডাক বুদ্ধের, ওড়াল তৃণমূল

পুরভোটের প্রচারে এক দিনও বেরোননি। কিন্তু ভোটের মুখে বাম প্রার্থী-সহ কর্মী ও সমর্থকদের উপরে হামলার ঘটনা বাড়তে থাকায় আসরে নামলেন তিনি। কলকাতায় পুরভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দিয়েই ‘সঙ্ঘবদ্ধ ও সর্বাত্মক প্রতিরোধে’র ডাক দিল সিপিএম। গত পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটে বাম নেতৃত্ব জোর গলায় প্রতিরোধের ডাক দিতে না পারায় মাঠে দাঁড়িয়ে শাসক দলের সঙ্গে লড়াইয়ের মনোবলটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন নিচু তলার কর্মীরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বিশাখাপত্তনম ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৬
Share: Save:

পুরভোটের প্রচারে এক দিনও বেরোননি। কিন্তু ভোটের মুখে বাম প্রার্থী-সহ কর্মী ও সমর্থকদের উপরে হামলার ঘটনা বাড়তে থাকায় আসরে নামলেন তিনি। কলকাতায় পুরভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দিয়েই ‘সঙ্ঘবদ্ধ ও সর্বাত্মক প্রতিরোধে’র ডাক দিল সিপিএম।

গত পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটে বাম নেতৃত্ব জোর গলায় প্রতিরোধের ডাক দিতে না পারায় মাঠে দাঁড়িয়ে শাসক দলের সঙ্গে লড়াইয়ের মনোবলটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন নিচু তলার কর্মীরা। সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার পুরভোটের আগে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররা বলছিলেন, বামেরা এক ইঞ্চি জমিও ছাড়বে না। ভোটের দিন যত এগোবে, বিরোধীদের উপরে আক্রমণের ঘটনাও তত বাড়বে বলে আশঙ্কাও ছিল তাঁদের। কার্যক্ষেত্রে তেমনই ঘটতে থাকায় বৃহস্পতিবার বিবৃতি জারি করে বাম কর্মী-সমর্থকদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন বুদ্ধবাবু। বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেই সাধারণ মানুষ যাতে ভোট দিতে বেরোন, সেই আবেদনও করলেন তিনি।

বুদ্ধবাবুকে দিয়ে এই বিবৃতি জারির পিছনে যাঁরা রয়েছেন, সেই বিমানবাবু, সূর্যবাবুরাও এ দিন বিশাখাপত্তনমের মঞ্চে তুলে আনলেন পুরভোটে সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ। এবং সেই লড়াইয়ে পাশে পেয়ে গেলন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক কোডিয়ারি বালকৃষ্ণনদেরও। বাংলার লড়াইয়ের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে পার্টি কংগ্রেসে প্রস্তাব পেশ করলেন মানিকবাবু। তাঁকে সমর্থন জানালেন বালকৃষ্ণন। এই সমর্থনে উত্সাহিত হয়ে বৃন্দা কারাট থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের নেতারা বার্তা দিলেন— মার খেয়েও তাঁদের কর্মীরা আত্মসমর্পণ করবেন না!

বাম সরকার থাকাকালীন নানা নির্বাচনের আগে শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে তত্কালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন সাধারণ মানুষকে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিরোধের আহ্বান জানাতেন, বুদ্ধবাবুদের এখনকার আবেদন অনেককে সেই ঘটনাই মনে করিয়ে দিচ্ছে! অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তদের জায়গা শুধু বদলে গিয়েছে! ঠিক সে ভাবেই বিরোধীদের অভিযোগ আসলে সাংগঠনিক দুর্বলতা আড়াল করার চেষ্টা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে বতর্মান শাসকেরাও।

কলকাতায় পুরভোটের প্রচার শেষ হয়েছে এ দিনই। তার দিন দুয়েক আগে থেকেই শাসক দলের হামলার মাত্রা বেড়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। গত ৪৮ ঘণ্টায় চার দিকে যে সব হামলা হল, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিশানা বামেরা। শেষ দিনেও সিপিএমের মিছিলে হামলা, প্রার্থী ও দলের সমর্থকদের গুরুতর আহত হওয়া, প্রার্থীর পরিবার ও পোলিং এজেন্টের উপরে হামলা এবং নানা জায়গায় হুমকির অভিযোগ পেয়েছেন বিমানবাবুরা। আর তার পরেই বিশাখাপত্তনম থেকে তাঁরা আলিমুদ্দিনে যোগাযোগ করে বুদ্ধবাবুর মাধ্যমে চূড়ান্ত আবেদন জারির সিদ্ধান্ত নেন। সেই মতোই এ দিন বিবৃতি দিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা তৃণমূল ভয়-ভীতি ও

সন্ত্রাসের আবহ তৈরির চেষ্টা করছে। স্বভাবতই কিছু নেতা ও কর্মীর মনে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, আমরা কি তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের আক্রমণের মুখে দাঁড়াতে পারব? এই প্রশ্নের মীমাংসা আমাদের উপরেই নির্ভর করছে। আমরাই পারব এর মোকাবিলা করতে।’’ ভোটের দিন সকাল থেকে বামপন্থী কর্মীরা যাতে কোনও ভাবেই পরিস্থিতির দখল শাসক দলের বাহিনীর হাতে চলে যেতে না দেন, সেই নির্দেশ দিয়ে বুদ্ধবাবু বলেছেন, ‘‘ভয় দেখিয়ে ক’জনকে রোখা যাবে? ক’টা ঘটনা ঘটানো যাবে? প্রয়োজন সঙ্ঘবদ্ধ ও সর্বাত্মক প্রতিরোধ।’’ একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর আর্জি, ‘‘নির্বাচনের দিন অবশ্যই ভোট দিন। কোনও বাধা-বিপত্তি মেনে নেবেন না। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য বদ্ধপরিকর। আমাদের বিশ্বাস, আপনারাও গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক দায়িত্ব পালন করবেন।’’

শহরে সিপিএমের সাংগঠনিক শক্তি আহামরি কিছু নয়। তা হলে কী ভাবে প্রতিরোধের ডাক দিচ্ছেন বিমান-সূর্যরা? সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা, প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে নিজেদের জায়গা ধরে রেখে বিধানসভা ভোটের আগে কিছুটা হলেও হারানো জমি ফিরে পাওয়ার জন্যই বাম নেতৃত্ব প্রতিরোধের ডাক দিচ্ছেন। মানুষ যাতে শাসক দলের ‘সন্ত্রাসে’র বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন, সেই লক্ষ্যে সব বিরোধী দলকেই নিজেদের বার্তায় জড়িয়ে নিয়েছেন তাঁরা।

বামেদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে নারাজ শাসক তৃণমূলের নেতৃত্ব। বুদ্ধবাবুর বিবৃতিকে যেমন ভোটের আগেই পরাজয়ের ইঙ্গিত বলে অভিহিত করেছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়! তিনি বলেন, ‘‘বুদ্ধবাবুর বিবৃতি আসলে কর্মসূচিহীন সিপিএম কর্মীদের ভোকাল টনিক দেওয়ার চেষ্টা!’’ তাঁর আরও কটাক্ষ, ‘‘কাদের দিয়ে তিনি প্রতিরোধ করবেন, বোঝা গেল না! তবে সেই প্রতিরোধ যদি ৩৪ বছরে হার্মাদ বাহিনী দিয়ে করা হয়, তা হলে মানুষই তাঁর যোগ্য জবাব দেবে!’’

উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, সন্ত্রাসের অভিযোগ এবং তা খারিজ করা— এই দুই প্রশ্নেই বিরোধী ও শাসক শিবিরে ভিন্ন মতও আছে। সিপিএমের একাংশ মনে করে, অতীতের কৃতকর্মের ফলই এখন ভুগতে হচ্ছে! দলের প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস যে ভাবে পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামে গ্রামে সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দিতেন, এখন মমতাও সব বিরোধীদের ‘নাটক’ বলে নস্যাত্ করে দিচ্ছেন!

আবার প্রকাশ্যে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও কলকাতার বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিরোধীদের উপরে হামলার খবরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ উদ্বিগ্ন। একান্তে অনেকেই বলছেন, ‘‘আমাদের দল কি বিরোধীহীন পুরবোর্ড চাইছে? এ জিনিস বন্ধ না করলে ভবিষ্যতে আমাদেরও বড় সমস্যার মুখে পড়তে হবে!’’ সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, কলকাতায় বামেরা প্রায় ৩০% ভোট পেতে পারে। তৃণমূল ৪৪% ভোট পেয়ে অনায়াসেই জিতবে বলেও সমীক্ষার আভাস। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ৪-৫% ভোট এ দিক-ও দিক হলে অনেক হিসেব ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কা করেই নির্বাচনের দিনের আগে শাসক দল সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করছে বলে সিপিএমের অন্দরে আলোচনা হচ্ছে। এই বক্তব্যের সঙ্গেও একমত শাসক দলের একাংশও। তৃণমূলের এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, ‘‘বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হচ্ছে বলে আমাদের কিছু এসে যাচ্ছে না। কিন্তু অন্য ভাবে দেখলে তো শিয়রে সমন! বামেরা ৩০%-র বেশি ভোট পেলে কিন্তু বিপদ আছে!’’

পার্থবাবু অবশ্য প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘‘কোথায় কী সন্ত্রাস হচ্ছে, খবর নিচ্ছি। তবে ২১৯০টি আসনের (রাজ্য জুড়ে সব ক’টি পুরসভা মিলিয়ে) মধ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে চার-পাঁচটি জায়গায় গোলমাল হয়েছে। আসলে কর্মসূচিহীন বিরোধীরা সংবাদমাধ্যমে ভেসে থাকার জন্য বিশৃঙ্খলা তৈরি করার চেষ্টা করছে! বাধা দিলে গোলমাল হচ্ছে।’’ একই সঙ্গে পার্থবাবুর আরও মন্তব্য, ‘‘জলভর্তি কলসি নিয়ে যেতে গেলে ছিটকে একটু জল তো পড়েই!’’

পক্ষান্তরে সিপিএম পুরভোটের আগে হামলার জন্য দায়ী করেছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকেই। বৃন্দার কথায়, ‘‘আমাদের কর্মীরা প্রতিবাদে সামনের সারিতে আছে বলেই রক্তাক্ত হচ্ছে।’’ পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে প্রস্তাব এনে সিপিএমের সুভাষিণী আলি বলেন, তাপস পালদের পাশে মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়িয়েছেন বলে নারীদের সুরক্ষার এমন দুরবস্থা হয়েছে।

প্রচারের শেষ বেলায় পথে নেমে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, নিরন্তর কুত্সা চালিয়ে তাঁকে ‘ডাকাতরানি’, ‘চোরেদের সর্দার’ বলা হচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় প্ররোচনা বাড়ছে। তবু তৃণমূল কর্মীরা কেউ প্ররোচনায় পা দেবেন না! বিশাখাপত্তনমে সেই খবর পেয়ে সিপিএম নেতারা বলছেন, ১৯৪৬ সালে কলকাতার কুখ্যাত রক্তলীলার আগে সুরাবর্দি তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ধর্মতলায় দু’টো বন্দুকের দোকান আছে। কেউ যেন সে দিকে যাবেন না! তার পরেই দলে দলে লোক ওই দুই দোকানের দিকেই দৌড়েছিল! মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিতটা তেমনই! শুনে তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ একান্তে বলছেন, ১৯৪৬ আর ২০১৫-র মাঝে আরও কিছু বছরও তো ছিল।

সব মিলিয়ে, ভোটের ঠিক আগে বামেদের সঙ্গে টক্করের আবহই এখন জোরদার মহানগরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE