Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal News

১৭ মন্ত্রীর এলাকায় হার, কেউ মিডিয়াকে এড়াচ্ছেন, কেউ বলছেন, গোলমাল ছিল ইভিএম-এ

শুধু জলপাইগুড়িতে নয়, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি নজির গড়েছে গোটা রাজ্যেই। যে ১৭ মন্ত্রীর কেন্দ্রে তৃণমূল হরেছে, তার মধ্যে ডাবগ্রাম ফুলবাড়িতেই হারের ব্যবধান সবচেয়ে বেশি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৯ ১৪:০০
Share: Save:

দক্ষিণ ও মধ্যবঙ্গে ঈষৎ স্বস্তিতে থাকা যেতে পারে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখার পরে তৃণমূল নেতৃত্বের প্রাথমিক ধারণা এই রকমই হয়েছিল। উত্তরে এবং জঙ্গলমহলে যতটা ধাক্কা খেয়েছে রাজ্যের শাসক দল, মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গে ধাক্কার তীব্রতা তার চেয়ে কম বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু বিশদ কাটাছেঁড়া শুরু হতেই বোঝা গিয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে গড় বলে মনে হচ্ছে যে সব এলাকাকে, সেখানেও সঙ্কট গভীর হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। রাজ্যের ১৭ জন মন্ত্রীর নির্বাচনী ক্ষেত্রে বিজেপির চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল। সেই কেন্দ্রগুলির অধিকাংশই কিন্তু মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গে।

সবচেয়ে জোরদার ধাক্কাটা খেয়েছেন যে মন্ত্রী, তাঁর নাম গৌতম দেব। এক সময়ে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠা গৌতম এখন রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী। তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি পড়ে জলপাইগুড়ি লোকসভা আসনে। জলপাইগুড়িতে অপ্রত্যাশিত হারের মুখ দেখতে হয়েছে তৃণমূলকে। লক্ষাধিক ভোটে জিতেছেন বিজেপির জয়ন্ত রায়। ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে গৌতম দেবের ডাবগ্রাম ফুলবাড়িতেই সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে তৃণমূল। ওই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ৮৬ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি।

শুধু জলপাইগুড়িতে নয়, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি নজির গড়েছে গোটা রাজ্যেই। যে ১৭ মন্ত্রীর কেন্দ্রে তৃণমূল হেরেছে, তার মধ্যে ডাবগ্রাম ফুলবাড়িতেই হারের ব্যবধান সবচেয়ে বেশি।

সবচেয়ে কম ভোটে হার যে মন্ত্রীর কেন্দ্রে, তিনি পূর্ণেন্দু বসু। রাজারহাট-গোপালপুরের বিধায়ক পূর্ণেন্দু। তাঁর আসনে বিজেপি এগিয়ে গিয়েছে ৭৪৩ ভোটে। পাশের বিধানসভা কেন্দ্র বিধাননগরও আর এক মন্ত্রীর, সুজিত বসুর। সে এলাকায় প্রায় ১৯ হাজার ভোটে বিজেপি এগিয়ে গিয়েছে।

পূর্ণেন্দুর অনুগামীদের একাংশ দাবি করছেন, রাজারহাট গোপালপুরে ফলাফল ভাল। কীসের ভিত্তিতে তাঁরা বলছেন এ কথা? সুজিত বসুর কেন্দ্রে বড় ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ার দিকে আঙুল তুলে পূর্ণেন্দু অনুগামীরা বোঝাতে চাইছেন, লাগোয়া এলাকা হওয়া সত্ত্বেও পূর্ণেন্দুর আসনে অনেকটা আটকে দেওয়া গিয়েছে গেরুয়া হাওয়া। কিন্তু সুজিত অনুগামীরা পাল্টা সামনে আনছেন অন্য তত্ত্ব। সুজিতের আসন যে লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে, সেই বারাসতে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পিছিয়ে পড়েছে দল। কিন্তু পূর্ণেন্দুর রাজারহাট-গোপালপুর যে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেই দমদমে বাকি ৬টা বিধানসভা কেন্দ্রেই তৃণমূলের সৌগত রায় এগিয়ে থেকেছেন। সূতরাং একমাত্র পূর্ণেন্দুই মুখ ডুবিয়েছেন সৌগতর, বলছেন বিধাননগরের তৃণমূল কর্মীদের একাংশ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

উত্তরবঙ্গে গৌতম দেবের আসন ছাড়া আর যে যে মন্ত্রীর আসনে তৃণমূল পিছিয়ে পড়েছে, তাঁরা হলেন বিনয় বর্মন, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, বাচ্চু হাঁসদা। জঙ্গলমহলে মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতর আসন বলরামপুরে বিজেপির এগিয়ে থাকার ব্যবধান ৩৫ হাজারের আশেপাশে। আর শ্যামল সাঁতরার আসন কোতুলপুরে বিজেপি হাজার দশেক ভোটে পিছনে ফেলেছে তৃণমূলকে। তবে উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহলের এই সম্মিলিত তালিকাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গে রথী-মহারথীদের পিছিয়ে পড়ার লিস্ট।

পূর্ণেন্দু বসু ও সুজিত বসু ছাড়াও উজ্জ্বল বিশ্বাস, রত্না কর ঘোষ, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, শশী পাঁজা, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, লক্ষ্মীরতন শুক্ল, তপন দাশগুপ্ত, মলয় ঘটক— এত জন মন্ত্রীর আসনে দক্ষিণ ও মধ্যবঙ্গে হার হয়েছে তৃণমূলের। রাজ্যের যে এলাকায় অধিকাংশ আসন ধরে রাখতে পারার সুবাদে এখনও তৃণমূল দাবি করতে পারছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধানসভা আসন এখনও তৃণমূলেরই অনুকূলে, সেই এলাকাতেই প্রায় এক ডজন মন্ত্রীর আসনে কী ভাবে এমন ঝড় তুলে দিল বিজেপি, সে প্রশ্ন বেশ উদ্বেগে রাখছে তৃণমূলকে।

কলকাতায় যে দুই মন্ত্রীর কেন্দ্রে পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল, তার মধ্যে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের রাসবিহারীতে গত লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপিই এগিয়ে ছিল। শশী পাঁজার শ্যামপুকুর নতুন সংযোজন, তবে ব্যবধান খুব বেশি নয়, হাজার দু’য়েক।

কী বলছেন মন্ত্রীরা এই হারের বিষয়ে? উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার বিধায়ক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আপাতত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথোপকথন এড়িয়ে চলছেন। ফল ঘোষিত হওয়ার পরেই জ্যোতিপ্রিয় আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, মানুষকে নিশ্চয়ই বোঝানো যায়নি। বোঝানোর চেষ্টা করা হবে। কিন্তু তার পর থেকে আর একটা কথাও তিনি প্রায় কোথাও বলেননি হাবড়ায় ১৮ হাজারেরও বেশি ভোটে পিছিয়ে পড়া প্রসঙ্গে।

আরও পড়ুন: ভুতুড়ে ভোটার! ১০০-র বেশি লোকসভা আসনের ফল প্রশ্নের মুখে

যে মন্ত্রীর আসনে সবচেয়ে বেশি ভোটে পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল, উত্তরবঙ্গের সেই গৌতম দেব অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে এড়াচ্ছেন না। আনন্দবাজারকে গৌতম দেব বললেন, ‘‘ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে এই ফলাফল আমার কাছেও অপ্রত্যাশিত। সূতরাং কী হয়েছে, কেন এমন ঘটল, সেটা এত সহজে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। পর্যালোচনা করছি। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যাচ্ছি। আমার কর্মীদের নিয়ে মিটিং করছি। বোঝার চেষ্টা করছি, সমস্যাটা কোথায় হল।’’ নিজের আসনে সব এলাকার পর্যালোচনা এখনও শেষ করতে পারেননি গৌতম। সবটা খতিয়ে দেখার পরেই যা বলার বলবেন, জানাচ্ছেন এমনই। কিন্তু এর মধ্যেই দলকে একটা রিপোর্ট তিনি দিয়েছেন, যার বিষয়বস্তু প্রকাশ্যে আনতে তিনি রাজি নন।

আরও পড়ুন: রাম নয়, সমস্যা রাজনীতি, নিজের ‘জয় শ্রীরাম’ ক্ষোভের ব্যাখ্যা দিলেন মমতা

বিষ্ণুপুরে হেরে যাওয়া প্রার্থী তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা কিন্তু অত বিশদ পর্যালোচনায় বিশ্বাসী নন। তিনি নিজে যে আসনের বিধায়ক, সেই কোতুলপুরে পিছিয়ে পড়লেন কী করে? শ্যামলের জবাব, ‘‘কী করে পিছিয়ে পড়লাম, ঠিক বুঝতে পারছি না। সমস্ত রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তার পরেও এমন ফলাফল কী ভাবে হয়, জানি না।’’ তা হলে কি মেরুকরণের হাওয়া? ফলাফল বলছে, বাগদি-বাউড়িরা এই নির্বাচনে বিপুল ভাবে বিজেপির দিকে, মেরুকরণের কারণেই কি তেমনটা হল? শ্যামল সাঁতরা মানতে নারাজ। বললেন, ‘‘মেরুকরণ হয়েছে বলে মনে করছি না। মানুষের উপরে আমাদের বিশ্বাস রাখতেই হবে। আমার একটা অন্য সন্দেহ হচ্ছে।’’ কী সন্দেহ? শ্যামল বললেন, ‘‘ইভিএম-এই কিছু একটা হয়েছে বলে আমার মনে হয়। ইভিএম-এ কারচুপি না থাকলে এই ফলাফল হওয়া সম্ভব নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Minister TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE