Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
দিল্লির নোটে অভিযুক্ত কালচিনির বিধায়কও

চন্দন-চালানে চম্প্রমারির নাম

মহিলা ডিএম’কে কটূক্তির রেশ না-মেলাতেই তিনি নতুন বিতর্কের কেন্দ্রে। ধারে-ভারে যার গুরুত্ব আরও অনেক বেশি। কালচিনির তৃণমূল বিধায়ক সেই উইলসন চম্প্রমারির নাম এ বার জড়িয়ে গিয়েছে চন্দনকাঠের চোরাচালানের সঙ্গে! সুদূর দক্ষিণ ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার হয়ে কী ভাবে ভুটানে রক্তচন্দনের সম্ভার নিয়মিত পাচার হচ্ছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সম্প্রতি সেই তথ্য সংবলিত ‘নোট’ পাঠিয়েছে নবান্নে।

উইলসন চম্প্রমারি তৃণমূল বিধায়ক

উইলসন চম্প্রমারি তৃণমূল বিধায়ক

দেবজিৎ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

মহিলা ডিএম’কে কটূক্তির রেশ না-মেলাতেই তিনি নতুন বিতর্কের কেন্দ্রে। ধারে-ভারে যার গুরুত্ব আরও অনেক বেশি। কালচিনির তৃণমূল বিধায়ক সেই উইলসন চম্প্রমারির নাম এ বার জড়িয়ে গিয়েছে চন্দনকাঠের চোরাচালানের সঙ্গে!

সুদূর দক্ষিণ ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার হয়ে কী ভাবে ভুটানে রক্তচন্দনের সম্ভার নিয়মিত পাচার হচ্ছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সম্প্রতি সেই তথ্য সংবলিত ‘নোট’ পাঠিয়েছে নবান্নে। আর সেখানেই রয়েছে শাসকদলের ওই বিধায়কের নাম। নোটের দাবি, কালচিনিতে উইলসনের এলাকায় চোরাই চন্দনকাঠের বেশ কিছু গুদামের হদিস মিলেছে শুধু নয়, ভুটানে কাঠ পাচার করার ক্ষেত্রেও তাঁর মদত ছিল। বিধায়কের খাসতালুক হওয়ায় এত দিন স্থানীয় প্রশাসন এ সম্পর্কে নাক গলায়নি বলে কেন্দ্রের অভিযোগ।

উইলসন অবশ্য এই অভিযোগকে ‘গল্প’ বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি এলাকার উন্নয়নের কাজকর্ম নিয়ে থাকি। বুঝতে পারছি না, আমার নাম কী ভাবে চোরাকারবারে জড়াল।’’ বিধায়কের দাবি, এটা আসলে তাঁর বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ ছাড়া কিছু নয়।

প্রসঙ্গত, দু’দিন আগেই মহিলা জেলাশাসকের নামে অশ্লীল কথাবার্তা বলে বিতর্কে জড়িয়েছেন উইলসন। তাঁর বিধানসভা-এলাকাভুক্ত জয়গাঁয় সরকারি জমি থেকে কিছু লোককে উচ্ছেদ করার প্রতিবাদে এসডিও-বিডিও অফিসের সকলকে পুড়িয়ে মারার হুমকিও দেন তিনি। সেই বিতর্ক টাটকা থাকতেই চন্দনকাঠ চোরাচালানে উইলসনের নাম জড়িয়ে কেন্দ্রের চিঠি পৌঁছেছে নবান্নে।

এর প্রেক্ষাপট কী?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, গত ১৯ এপ্রিল অন্ধ্র পুলিশের একটি দল (যারা শুধু চন্দনকাঠ চোরাকারবারীদের খুঁটিনাটি হদিস রাখে) হাসিমারায় তল্লাশি চালিয়ে সৌন্দ্রারা রাজন নামে এক কাঠ-মাফিয়াকে গ্রেফতার করে। একই দিনে তামিলনাড়ুর শেষাচলম পাহাড়িতে ধরা পড়ে রাজনের ঘনিষ্ঠ শাগরেদ সারভানন। দু’জনকে জেরা করে পাওয়া তথ্য অন্ধ্র পুলিশ রিপোর্ট আকারে পাঠায় কেন্দ্রকে। আর তারই ভিত্তিতে তদন্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ‘নোট’ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। যাতে উইলসন ছাড়াও তাঁর বাবা সুবিন চম্প্রমারি, জয়গাঁর শ্যাম বিশ্বকর্মা ও মিরিকের প্রেম লামা-সহ জনা ছয়েকের নাম আছে বলে পুলিশ-সূত্রের দাবি। এঁদের বিরুদ্ধে রক্তচন্দন চোরাচালানে মদতদানের অভিযোগ আনা হয়েছে।

অন্ধ্র পুলিশ মনে করছে, রাজনকে জালে ফেলাটাই তাদের মস্ত সাফল্য। কারণ, রাজনের দুষ্কর্মের শিকড় ছিল ওই রাজ্যেই। বস্তুত চন্দনদস্যু বীরাপ্পনের মতো ‘কিংবদন্তী’ না-হলেও সে যে কায়দায় দক্ষিণ ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গ-ভুটানে পাচারের কারবার ফেঁদে বসেছিল, তাতে ঘুম ছুটেছিল অন্ধ্র পুলিশের। উল্লেখ্য, তামিলনাড়ু-কর্নাটক-অন্ধ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চন্দনগাছের জঙ্গল থাকার সুবাদে দক্ষিণ ভারত বরাবরই তার চোরাচালানের কেন্দ্র।

অন্ধ্র পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘আদতে মায়ানমারের নাগরিক রাজন গত বছর দশেক যাবৎ দক্ষিণ ভারতে ঘাঁটি গেড়ে ছিল। দক্ষিণী বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় তার নামে অন্তত তিরিশটি মামলা। শেষে সে কালচিনির এক ডেরায় এসে গা ঢাকা দিয়েছিল।’’ সেই মতো ছক কষে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মদতে হাসিমারার জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে রাজনকে পাকড়াও করা হয়। তার কাছে প্রায় ছ’কোটি টাকার রক্তচন্দন মিলেছে বলে জানিয়েছেন ওই অফিসার।

কী ভাবে কারবার চালাচ্ছিল রাজন-চক্র?

কেন্দ্রীয় রিপোর্ট বলছে, খাস চেন্নাই ও দক্ষিণের বিভিন্ন শহর-গঞ্জ থেকে চোরাই-চন্দনকাঠ সড়কপথে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হতো। ‘মাল’ খালাসের জায়গা ছিল হাসিমারা বায়ুসেনা হাসপাতাল মোড় লাগোয়া মধ্য সাতালি গ্রামে। এর পরে আসত মজুতের পালা। আর এ প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে শাসকদলের বিধায়ক ও তার ‘প্রভাবের’ ভূমিকা। কী রকম?

কেন্দ্রীয় নোটের দাবি, চম্প্রমারির এলাকাভুক্ত মেচি বস্তিতে চোরাই চন্দনকাঠের স্তূপ লুকিয়ে রাখা হতো সুপারিগাছে ঢেকে। সেখানে এমন ১০-১৫টি গুদামের হদিসও মিলেছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের এ-ও ইঙ্গিত, শাসকদলের ‘এমএলএ’র প্রতিপত্তির সুবাদে বন দফতর তো বটেই, স্থানীয় পুলিশ বা প্রশাসন এ ব্যাপারে চোখ বুজে থাকত। পাশাপাশি দিবারাত্র চলত পাচারকারীদের নিজস্ব নজরদারি। এমনকী, তল্লাটে ‘সন্দেহজনক’ কোনও নতুন মুখ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে যেত তাদের ‘নেটওয়ার্কে।’

ফলে চালান খালাস ও মজুতের কাজ নির্বিবাদে হয়ে এসেছে এত দিন। পাচারের পরবর্তী পর্ব কী ভাবে সারা হচ্ছিল, নোটে তারও বিবরণ রয়েছে। বলা হয়েছে, সন্ধের ব্যস্ত সময়ে সিমেন্টবোঝাই ছোট ট্রাকে চেপে চন্দনকাঠ রওনা দিত ভুটানের ফুন্টশোলিংয়ে। এই কাজে দ্বিগুণ টাকা, কাজেই ট্রাক-মালিকদের লাইন পড়ে যায়। উপরন্তু গোটা যাত্রাপথের ‘নিরাপত্তা’য় বহাল থাকত মোটরবাইক আরোহীরা, যারা আদতে বিধায়কের লোক হিসেবে এলাকায় পরিচিত। মন্ত্রকের সূত্র জানাচ্ছে, ফুন্টশোলিংয়েই চালানের হাতবদল হয়। ভারতীয় ‘এজেন্ট’দের জায়গায় আসে ভুটানের ‘এজেন্ট’রা। রাস্তায় চন্দনের ট্রাক ধরা পড়লে কোন তরফ ক্ষতির কতটা বহন করবে, তা-ও আগাম স্থির করা থাকে।

তবে ভুটানেই ইতি নয়। কেন্দ্রীয় দাবি, ভুটান থেকে রক্তচন্দন যায় তিব্বতে। ওই ‘রুটে’ বড় গাড়ি চলাচলের উপযোগী রাস্তা না-থাকায় চন্দনকাঠ সওয়ার হয় ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়াবাবদ মজুরি— ভারতীয় মুদ্রায় দশ হাজার টাকা।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, চেন্নাই থেকে সড়কপথে এতটা উজিয়ে চোরাই চন্দনকাঠ উত্তরবঙ্গে আসছিল, অথচ কারও নজরে পড়তো না?

মন্ত্রকের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘রাজনের বিশাল নেটওয়ার্ক। বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ ও বন দফতরের একাংশের সঙ্গে তার বন্দোবস্ত ছিল। পারতপক্ষে ওদের ট্রাকে কারও হাত পড়ত না।’’ অন্ধ্র পুলিশের এক সূত্রের দাবি, ‘‘অন্ধ্রের এক প্রাক্তন মন্ত্রী ও তামিলনাড়ুর এক প্রাক্তন বিধায়ক ছাড়াও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতার প্রচ্ছন্ন মদত রাজনের পিছনে। রাজন-সারভাননের মোবাইল কল-লিস্ট ঘেঁটেও বেশ কিছু নেতার নাম পাওয়া গিয়েছে। সেগুলো ইতিমধ্যে দিল্লিকে জানানো হয়েছে।’’

এত কাণ্ড ঘটে গেল। এ রাজ্যের পুলিশ কিছু জানে না?

নবান্নের পুলিশ-কর্তাদের বক্তব্য: দক্ষিণ ভারত থেকে চোরাপথে আসা চন্দনকাঠ যে কালচিনি-হাসিমারায় মজুত করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা পুলিশ (আইবি) একাধিক বার প্রশাসনকে রিপোর্ট দিয়েছে। ওখানকার জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে টন টন রক্তচন্দন উদ্ধারও হয়েছে। ‘‘তবে এ ক্ষেত্রে দিল্লি যে ভাবে শাসকদলের বিধায়কের দিকে আঙুল তুলেছে, তেমন কোনও ইঙ্গিত আইবি’র রিপোর্টে পাওয়া যায়নি।’’— বলছেন রাজ্য পুলিশের এক কর্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE