Advertisement
E-Paper

কসবা নিয়ে আরজি করের মতো নাগরিক আন্দোলন হবে রাজ্যে? বিরোধীরা সমস্বর, পথে নামছেন ‘রাতদখলকারী’রা, সতর্ক শাসক

‘শিক্ষা’ শুধু বিজেপি নেয়নি। আরজি কর পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়েছে তৃণমূলও। তাই কসবার ঘটনায় শুক্রবারের পরে শনিবারেও তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া সতর্ক, সাবধানী এবং ঈষৎ রক্ষণাত্মক।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ ১৩:৪৭
TMC on defensive stance as protest against Kasba’s Rape incident starts resembling post-RG Kar situation

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরে বছরও ঘোরেনি। তার মধ্যেই গণধর্ষণের ঘটনা সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের কসবা ক্যাম্পাসে। তফাত, আরজি করের নির্যাতিতা জুনিয়র চিকিৎসক খুন হয়েছিলেন। কসবার আইন-ছাত্রী বেঁচে রয়েছেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় ফারাক দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং একাধিক অরাজনৈতিক সংগঠনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বলছে, আরজি করের আন্দোলন যেখানে থেমে গিয়েছিল, সেখান থেকেই কসবার ঘটনায় আন্দোলনের পরিসর তৈরি হচ্ছে। এখন প্রশ্ন একটাই— আরজি করের ঘটনায় যে নাগরিক আন্দোলন দেখা গিয়েছিল, কসবাকাণ্ডও কি সেই পথেই এগোবে?

কসবাকাণ্ডের প্রতিবাদে শুক্রবার থেকেই রাস্তায় নেমেছে বিরোধী দলগুলি। মূলস্রোতের রাজনৈতিক দল তো বটেই, ছোটখাটো রাজনৈতিক দলও কসবা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। আরও বিক্ষোভের পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি বিরোধী রাজনৈতিক দলই (তাদের আইনসভায় উপস্থিতি থাকুক বা না-থাকুক) কসবার ঘটনায় নিজেদের ‘প্রাসঙ্গিক’ করতে পথে নেমেছে। যা একেবারে অপ্রত্যাশিতও নয়। যেমন অপ্রত্যাশিত নয় এই পরিস্থিতিতে শাসক তৃণমূলের ঈষৎ ‘রক্ষণাত্মক’ হয়ে পড়া।

শুক্রবারেই কসবা থানার সামনে বিজেপি যুব মোর্চার সভাপতি ইন্দ্রনীল খাঁয়ের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয়েছে। পথে নামে কংগ্রেসও। পথ অবরোধ হয়। পুলিশ কয়েক জনকে আটক করে। এসইউসিআইয়ের ছাত্র সংগঠন ডিএসও মিছিল করে গণধর্ষণের ঘটনাস্থল সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের সামনে। পুলিশের সঙ্গে ধুন্ধুমার বাধে সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠনের কর্মীদের। বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়। নওশাদ সিদ্দিকির দল আইএসএফের ছাত্রশাখাও শুক্রবার সন্ধ্যায় কসবা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায়। তাদের উপর পুলিশি লাঠিচার্জের অভিযোগ ওঠে। যা থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, রাজ্যের রাজনীতি ফের আরজি কর পরবর্তী পরিস্থিতির ধাঁচে গরম হতে শুরু করেছে। শনিবারও দিনভর নানা এলাকায় বিক্ষোভ-অবরোধের সম্ভাবনা আছে।

পাশাপাশিই শুক্রবার থেকে বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনও প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করতে শুরু করেছে। রবিবার বিকালে কসবার আইন কলেজের সামনে জমায়েতের ডাক দিয়েছে একটি সংগঠন। বলা হয়েছে, ওই জমায়েতও আরজি কর পরবর্তী ‘রাতদখল’ কর্মসূচির মতোই হবে। আয়োজকদের সমাজমাধ্যমের পোস্টে সেই আভাস রয়েছে। আরজি করের ঘটনার পরে ‘রাতদখল’ কর্মসূচির অন্যতম উদ্যোক্তা রিমঝিম সিংহ সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে। আবার কলকাতা শহরকে কাঁপিয়ে তোলা দরকার।’’ কসবার ধর্ষণকে যে তাঁরা আরজি করের ঘটনার পরবর্তী পর্ব হিসেবেই দেখছেন, সে কথাও সমাজমাধ্যমের পোস্টারগুলিতে স্পষ্ট। সাধারণ নাগরিকেরা এমন আহ্বানে যোগ দেবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু কয়েকটি অরাজনৈতিক সংগঠন পথে নামার ডাক দেওয়ায় আন্দোলনের ‘পরিসর’ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যে রয়েছে, তা অনেকেই মনে করছেন।

পরিস্থিতি বুঝে তৃণমূল তথা টিএমসিপি (তৃণমূল ছাত্র পরিষদ) শুক্রবার থেকেই দাবি করতে শুরু করেছে যে, অভিযুক্তদের সঙ্গে সংগঠনের কোনও যোগাযোগ এখন আর নেই। দক্ষিণ কলকাতা জেলা টিএমসিপির সভাপতি সার্থক বন্দ্যোপাধ্যায় হন বা রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য, প্রত্যেকেরই দাবি, ২০২২ সালের পর থেকে অভিযুক্ত যুবক সংগঠনে নেই। তৃণমূলের যুক্তি, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই পুলিশ পদক্ষেপ করেছে। তিন অভিযুক্তকেই বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয়েছে। কাউকে আড়াল করার চেষ্টা হয়নি। সুতরাং এই ঘটনা নিয়ে ‘রাজনীতি’ হওয়া উচিত নয়।

আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি অবশ্য দাবি করেছে, অন্যতম অভিযুক্ত যুবক এখনও দক্ষিণ কলকাতা টিএমসিপি-র সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। বাকিদের সঙ্গেও টিএমসিপির যোগাযোগ রয়েছে। তাদের অভিযোগের সমর্থনে শুক্রবার রাত থেকে বিজেপি নানা ছবি প্রকাশ্যে আনতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালেও ওই অভিযুক্ত টিএমসিপিতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত রয়েছেন বলে বিজেপির প্রথম সারির নেতারা দাবি করতে শুরু করেন।

এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে-র বক্তব্য, ‘‘সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজকে কেন্দ্র করে তৃণমূল দীর্ঘ দিন ধরে অপরাধচক্র চালাচ্ছে।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘‘এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অভয়া থেকে তমন্না হয়ে কসবা একটা অভিন্ন ধারাবাহিক। সেই ধারাবাহিকের আলাদা আলাদা পর্ব সামনে আসছে।’’ এমন ঘটনা একের পর এক কেন ঘটছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সেলিম বলেছেন, ‘‘কলেজে কলেজে সমানে ভয় দেখানোর সংস্কৃতি, শাসানির সংস্কৃতি, ব্ল্যাকমেল করে শোষণের সংস্কৃতি চলছে। এরা জানে, মমতার একটা ছবি লাগিয়ে নিলেই যা খুশি করতে পারে। এদের সঙ্গে হয় কালীঘাটের যোগ রয়েছে, নয়তো ক্যামাক স্ট্রিটের। তাই এরা বেপরোয়া।’’

সেলিমের বক্তব্য, আরজি কর পরবর্তী প্রতিবাদের ধাঁচেই এ বারেও প্রতিবাদ হওয়া উচিত। তাঁর কথায়, ‘‘এটা সভ্যতার সঙ্কট। সাংস্কৃতিক সঙ্কট। মূল্যবোধের সঙ্কট। সুতরাং সকলকে নামতে হবে।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি তথা প্রাক্তন সাংসদ অধীর চৌধুরীও বলছেন, ‘‘এটা নাগরিক আন্দলনের চেহারা নেওয়া খুব দরকার। মানুষ তিতিবিরক্ত। বাংলায় নাগরিক সমাজের অভ্যুত্থান ছাড়া কিছু বদলাবে না। পশ্চিমবঙ্গে একটা ‘কালচার অফ ইমপিউনিটি’ তৈরি হয়েছে। অপরাধীরা জানে, অপরাধ করলেও কোনও শাস্তি হবে না।’’ বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ও নাগরিক সমাজকে পথে নামার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আরজি করের ঘটনার পরে বছর ঘোরেনি। তার মধ্যেই আবার এমন ভয়াবহ ঘটনা। এর প্রতিবাদে নাগরিক আন্দোলন হওয়াই উচিত। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আবার মানুষের রাস্তায় নামা উচিত।’’

তবে নাগরিক আন্দোলন চাইলেও আরজি কর পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে পাওয়া ‘শিক্ষা’ বিজেপি ভুলছে না। তখন জুনিয়র চিকিৎসকদের একাধিক কর্মসূচিতে বিজেপি নেতাদের ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীদের একাংশ। তাই রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এ বার সাবধানি। তাঁর কথায়, ‘‘এই আন্দোলন নাগরিক আন্দোলনের চেহারা নেবে কি না, তা নাগরিক সমাজের উপরেই নির্ভর করবে। আরজি করের ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ আন্দোলন করেছিল। আমরা তাতে ঢুকিনি। অরাজনৈতিক আন্দোলনকে অরাজনৈতিক চেহারাতেই থাকতে দিয়েছি। আমরা আলাদা প্রতিবাদ জানিয়েছি। এ বারও আমরা আলাদা ভাবেই প্রতিবাদ করব।’’

আরজি কর পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়েছে শাসক তৃণমূলও। শুক্রবারের পর শনিবারও তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া সতর্ক, সাবধানি এবং ঈষৎ রক্ষণাত্মক। দলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার যেমন প্রথমেই বলছেন, ‘‘খুবই দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত ঘটনা।’’ তার পরে তাঁর বক্তব্য, ‘‘এমন ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। রাজনৈতিকীকরণ এই ধরনের ঘটনার প্রতিষেধক তৈরি করছে না।’’ জয়প্রকাশের যুক্তি, ‘‘সব সুস্থ মনের মানুষ এই ঘটনার নিন্দা করছেন। সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে এই সামাজিক ব্যাধিকে নির্মূল করা উচিত। দলমত নির্বিশেষে ঘটনাটার নিন্দা করা সত্ত্বেও এর গায়ে রাজনীতির রং লাগানো হলে এই সমস্বর নিন্দা বা এই জঘন্য ঘটনাটা পিছনে চলে যাবে। রাজনীতিটা সামনে চলে আসবে। তখন এই সামাজিক রোগ সারানো আরও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে।’’

সন্দেহ নেই যে, আরজি করের ঘটনার পরে যে নাগরিক আন্দোলন রাজ্য এবং দেশ দেখেছিল, তা নজিরবিহীন। কিন্তু সেই আন্দোলন যত দ্রুত উচ্চগ্রামে পৌঁছেছিল, তেমনই দ্রুততায় তা স্তিমিতও হয়ে পড়েছিল। সন্দেহ নেই, কসবার ঘটনায় বিরোধী দলগুলি শাসদের বিরুদ্ধে পথে নামার মতো ‘রাজনৈতিক অক্সিজেন’ পেয়েছে। কিন্তু তারাও জানে, নাগরিক সমাজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কসবার ঘটনায় পথে না নামলে আরজি কর-পরবর্তী আন্দোলন এক ‘নজিরবিহীন’ হয়ে ইতিহাসই থেকে যাবে। তার তুল্য আন্দোলনের দ্বিতীয় নজির গড়ে উঠবে না।

Kasba Rape Case South Calcutta Law College TMCP AITC RG Kar Rape and Murder Case
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy