২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে ভাল ফল করার লক্ষে উন্নয়নকেই পাখির চোখ করতে চাইছে তৃণমূল। সেই সঙ্গে সংগঠনকেও চাঙ্গা করার একগুচ্ছ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শনিবার বারাসতে জেলা পরিষদের সভাগৃহে দলের জেলাস্তরের নেতানেত্রীদের উপস্থিতিতে এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। বিরোধীরা অবশ্য তৃণমূলের এমন সব পদক্ষেপ শুনে সমালোচনা করে বলছেন, দুর্নীতিতে-ভরা দল এখন বুঝতে পারছে, আসন্ন বিধানসভা ভোটে জনসমর্থন কমছে। সেই অবস্থা সামাল দিতেই এত তোড়জোড়় তৃণমূলে। সরকারি প্রকল্পের টাকা দলের ফান্ডে ঢোকানোর চক্রান্ত চলছে বলেও আশঙ্কা বিরোধীদের।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, প্রতিটি পঞ্চায়েত সমিতি ও পুরসভায় একটি করে নজরদারি কমিটি গঠন করা হবে। পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রে ওই কমিটিতে সমিতির সভাপতি ছাড়াও থাকবেন স্থানীয় বিধায়ক, সাংসদ, দলের জেলা পর্যবেক্ষক, সভাপতি। বিগত বছরগুলিতে জেলা পরিষদ বা অন্য কোনও প্রকল্পের কোন খাতে কত টাকা এসেছে, কত টাকা খরচ করা যায়নি, কত টাকা কোথায় খরচ হয়েছে, এ সবের বিস্তারিত হিসাব নেবে নজরদারি কমিটি। সেই হিসাব পাঠানো হবে জেলা নেতৃত্বকে। যদি এ ধরনের কমিটি তৈরিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির অনীহা দেখা যায়, তবে তাঁকে ‘সাময়িক বিশ্রামে’ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে বলেও দলীয় সূত্রে জানানো হয়েছে।
“জেলায় উন্নয়নের কাজ কোনও অবস্থাতেই ফেলে রাখা যাবে না।”
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (জেলা তৃণমূল সভাপতি)
এই মুহূর্তে উত্তর ২৪ পরগনার ২২টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ১৮টিতেই ক্ষমতায় আছে তৃণমূল। তা হলে এমন অতি সতর্কতার কারণ কী? ভোটের ফল নিয়ে কি তবে আশঙ্কায় আছেন নেতৃত্ব?
এ ক্ষেত্রে তৃণমূলের এক জেলা নেতার সাফাই, উত্তর ২৪ পরগনার ৩৩টি বিধানসভার সব ক’টিতেই জয়ী হতে চায় দল। এ জন্য বাড়তি ব্যবস্থা নিতেই হচ্ছে। তা ছাড়া, ক’দিন আগেই হাবরা ১ পঞ্চায়েত সমিতিতে সরকারি প্রকল্পের কাজ নিয়ে কিছু অস্বচ্ছতা দেখা দিয়েছে। যা নিয়ে দলকে কিছুটা অস্বস্তিতেও পড়তে হয়। বিধানসভা ভোটের এখনও খানিকটা দেরি থাকলেও যে কোনও রকম অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়াতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে চায় দল। উন্নয়ন নিয়ে যাতে স্থানীয় মানুষের কোনও রকম ক্ষোভ না থাকে, সে দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। সরকারি প্রকল্পের টাকা যাতে দ্রুত খরচ হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখবে নজরদারি কমিটি।
পুরসভাগুলির ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নজরদারি কমিটি। সে ক্ষেত্রে সাংসদ-বিধায়ক জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে ওই কমিটিতে থাকবেন পুরপ্রধান ও উপ পুরপ্রধানেরা। বিশেষ করে নিয়োগ বা জমি হস্তান্তর-সংক্রান্ত বিষয়গুলি এই কমিটিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
উত্তর ২৪ পরগনার অধিকাংশ পুরসভাগুলিতে ক্ষমতায় আছে তৃণমূল। সদ্য শেষ হওয়া ২৩টি পুরসভার ভোটে সব ক’টিতেই জয়ী হয়ে তারা। এ ক্ষেত্রে নতুন পুরসভাগুলির ক্ষেত্রে যাতে উন্নয়নের কাজে গতি আনা যায়, সে দিকেও বাড়তি নজর থাকবে বলে জানাচ্ছেন জেলা নেতৃত্ব। তবে পঞ্চায়েত সমিতিতে যেমন প্রয়োজনে সমিতির সভাপতিদের ‘সাময়িক বিশ্রামে’ পাঠানোর মতো শাস্তির খাঁড়া ঝোলানো হচ্ছে, পুরসভার ক্ষেত্রে তেমন ব্যবস্থা এখনই থাকছে না।
বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, পঞ্চায়েত, পুরসভার বেশির ভাগই যখন শাসক দলের দখলে, তখন ভোটের আগে কেন উন্নয়ন নিয়ে এত মাথা ঘামাতে হচ্ছে তাদের? জেলার সাংসদ-বিধায়কদের সিংহভাগও তৃণমূলের হাতে। তা হলে কি স্বস্তিতে নেই দল?
সিপিএমের এক নেতা বলেন, ‘‘এই ক’বছরে ওদের জনভিত্তি যে কমছে, তা বিলক্ষণ টের পাচ্ছে তৃণমূল। উন্নয়নের টাকা নিয়ে সর্বত্রই নানা দুর্নীতি চলছে। নিয়োগ-সংক্রান্ত ক্ষেত্রেও শাসক দলের ভাবমূর্তি খুব স্বচ্ছ নয়। গোটা জেলায় আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে। তোলাবাজি, সিন্ডিকেট রাজ চলছে নানা জায়গায়। সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠছে। এ সব সামলাতে না পারলে ভোটে যে ওরা এ বার বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না, তা টের পেয়েই এত কড়া পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।’’ দলের জেলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নেপালদেব ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সরকারি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করতেই এ সব করছে ওরা। সরকারি প্রকল্পের টাকা দলের ফান্ডে ঢুকবে ভোটের আগে।’’ বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘তৃণমূলের জমানায় উন্নয়ন কিছুই হয়নি। সে জন্যই ভোটের আগে একটা প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সরকারি টাকার উপরে দলীয় নিয়ন্ত্রণ আনতেই এ সব পদক্ষেপ করছে।’’
তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য বলেন, ‘‘জেলার সব বিধানসভা আসন এ বার আমরা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে উপহার দিতে চাই। সে জন্যই জেলা স্তরে এ সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘উন্নয়নের কাজ কোনও অবস্থাতেই ফেলে রাখা যাবে না।’’
তৃণমূল সূত্রের খবর, আগামী ছ’মাসে জেলায় ১৫ লক্ষ সদস্য পদের লক্ষমাত্রা নেওয়া হয়েছে। ৩৩টি বিধানসভা এলাকার সব ক’টিতে ৩০০ জন করে প্রাথমিক সদস্য করা হবে। এই ৩৩টি বিধানসভার মধ্যে এখন ২৯টিতেই ক্ষমতায় আছে তৃণমূল। সমস্ত জেলার প্রতিটি বুথে ১০ জন করে সক্রিয় কর্মী বাছাই করা হবে। যাঁদের ফোন নম্বর এবং যোগাযোগের ঠিকানা দলের রাজ্য কমিটির কাছে থাকবে। রাজ্য কমিটিকে প্রয়োজনে স্থানীয় স্তরে খোঁজ-খবরে সাহায্য করবেন এই বুথ-কর্মীরাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy