Advertisement
০৮ মে ২০২৪

শুভেন্দুর জমিতে ফুল ফোটালেন অভিষেক

দু’জনেই ‘যুবরাজ’। এক জন গোটা তৃণমূল সাম্রাজ্যের। দ্বিতীয় জন অধিকারী-রাজের।কিন্তু বিরোধীর ঘর দখল নিয়ে এই দুই যুবরাজের মধ্যে সূক্ষ্ম টক্কর দেখতে পাচ্ছেন শাসক শিবিরের অনেকেই। যে টক্করের ছায়া বেশ খানিকটা স্পষ্ট হল রবিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে বহরমপুর পুরসভা তৃণমূলের দখলে নেওয়ার সময়।

দলবদল। তৃণমূলে সই বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নীলরতন আঢ্য-সহ কংগ্রেসের ১৭ জনের। রবিবার তৃণমূল ভবনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

দলবদল। তৃণমূলে সই বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নীলরতন আঢ্য-সহ কংগ্রেসের ১৭ জনের। রবিবার তৃণমূল ভবনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৮
Share: Save:

দু’জনেই ‘যুবরাজ’। এক জন গোটা তৃণমূল সাম্রাজ্যের। দ্বিতীয় জন অধিকারী-রাজের।

কিন্তু বিরোধীর ঘর দখল নিয়ে এই দুই যুবরাজের মধ্যে সূক্ষ্ম টক্কর দেখতে পাচ্ছেন শাসক শিবিরের অনেকেই। যে টক্করের ছায়া বেশ খানিকটা স্পষ্ট হল রবিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে বহরমপুর পুরসভা তৃণমূলের দখলে নেওয়ার সময়।

বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নীলরতন আঢ্য-সহ ১৭ জন কাউন্সিলর এ দিন তৃণমূল ভবনে শাসক দলের পতাকা তুলে নিলেন অভিষেকের হাত ধরে। অথচ এ দিনই খাস বহরমপুরে সভা করতে উপস্থিত ছিলেন শুভেন্দু। তাঁর মঞ্চে যোগ দিলেন কংগ্রেসের মাত্র এক জন কাউন্সিলর, সুব্রত মৈত্র। তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্বের তরফে মুর্শিদাবাদ জেলার পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে কিন্তু শুভেন্দুই।

বহরমপুরে ২৮ আসনের পুরসভায় এত দিন তৃণমূলের দখলে ছিল মাত্র দু’টি আসন। এর মধ্যে একটি আসন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে এক কাউন্সিলরের মৃত্যুতে। কংগ্রেসের ১৮ জন তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় শাসক দলের কাউন্সিলরের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৯। কংগ্রেসের দখলে থাকা বহরমপুর পুরসভা দখল করতে তৃণমূলের প্রয়োজন ছিল ১৫টি আসন। তার থেকেও বেশিসংখ্যক কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে অভিষেক বলেন, ‘‘বলেছিলাম, এ বছর শেষ হওয়ার আগেই মুর্শিদাবাদ থেকে কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে! মুর্শিদাবাদে আমাদের বাইরে রয়েছে আর মাত্র দু’টি পুরসভা। আগামী এক মাসের মধ্যে সেই দু’টিও তৃণমূল দখল করবে।’’ লক্ষ্যণীয়, মুর্শিদাবাদ থেকে কংগ্রেসকে নিশ্চিহ্ন করার দিনক্ষণ আগে বেঁধে দিয়েছিলেন শুভেন্দুই!

বিরোধী শিবির ভাঙিয়ে শাসকের শক্তি বাড়ানোর লাগাতার ঘটনায় নৈতিকতার প্রশ্ন থাকছেই। যদিও অভিষেক ধরাবাঁধা ভঙ্গিতেই দাবি করেছেন, ‘‘এত দিন মুর্শিদাবাদের মানুষ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। সেই জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নে সামিল হতে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিরা তৃণমূলে আসছেন। আমরা মুর্শিদাবাদে উন্নয়ন আরও প্রসারিত করতে চাই।’’ সপ্তাহখানেক আগেই শুভেন্দু স্বীকার করেছিলেন, ‘‘বহরমপুরে এখনও আমাদের শক্তি কম।’’ তা হলে কোন ম্যাজিকে সেখানে পুরসভা তৃণমূলের দখলে চলে এল? কিছুটা থমকে অভিষেকের জবাব, ‘‘সবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ম্যাজিক!’’

তৃণমূলে যোগ দেওয়া ছাড়া যে বিরোধী হাতে-থাকা পুরসভায় উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছিল না, তা প্রায় স্বীকার করে নিয়েছেন বহরমপুরের নীলরতনবাবুই। অভিষেকের পাশে বসেই তিনি বলেন, ‘‘মুর্শিদাবাদ পিছিয়ে পড়া জেলা। দেখলাম জেলাটায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে উন্নয়ন হচ্ছে। তা হলে বহরমপুরই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? তাই চলে এলাম তৃণমূলে!’’

কিন্তু শাসক শিবিরে গুঞ্জন চলছে, নীলরতনবাবুরা কলকাতায় অভিষেকের হাত ধরে তৃণমূলে এলেন কেন? আর কেনই বা বহরমপুরে কংগ্রেসের গড় ভাঙার ‘নেপথ্যনায়ক’ সুব্রতবাবু শুভেন্দুর মঞ্চে দলবদল করলেন? সুব্রতবাবু নিজেই বলেছেন, ‘‘যাঁরা কলকাতায় গিয়ে দলবদল করছেন, তাঁরা যদি সত্যিই মমতার উন্নয়নে সামিল হতে চাইতেন, তা হলে জেলা পর্যবেক্ষক শুভেন্দুদা’র হাত থেকেই তৃণমূলের পতাকা নিতে পারতেন।’’ মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনেরও একই সুর, ‘‘ওঁরা সব কলকাতায় চলে গেলেন। মহিলা কাউন্সিলররা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে গিয়েছেন। এখন তো আর ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই! তবে ওঁরা এখানে যোগ দিলেই ভাল করতেন!’’ মান্নান-পুত্র, জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি সৌমিক হোসেন অবশ্য অভিষেকের পাশেই ছিলেন।

কংগ্রেস নেতাদের একাংশও স্বীকার করেন, মুর্শিদাবাদে নিয়মিত ‘জনসংযোগ’ বাড়িয়ে বিরোধী ঘরে ভাঙন ধরানোর অন্যতম কারিগর শুভেন্দুই। গত সপ্তাহে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ দখলের দিনেও শুভেন্দু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এ বার তাঁদের লক্ষ্য বহরমপুর পুরসভা। আর তার পরেই বহরমপুরে পতাকা ধরানোর আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব চলে এল অভিষেকের হাতে! যা দেখে শাসক দলেরই কেউ কেউ বলছেন, ‘‘বছরভর খেটে জমি তৈরি করলেন শুভেন্দু। আর ফুল ফোটানোর সময় কৃতিত্ব নিয়ে চলে গেলেন অভিষেক!’’

তৃণমূল ভবনে বহরমপুর পুরসভা দখলের ঘোষণার সময় এ দিন শুভেন্দুর নামোল্লেখও শোনা যায়নি যুব সভাপতির গলায়। অধীর চৌধুরীর কলজে ছিনিয়ে নেওয়ার যাবতীয় আলো শুষে নিয়েছেন যেন তিনিই! পরে অবশ্য অভিষেক পরিস্থিতি সামলাতে চেয়েছেন এই বলে যে, ‘‘শুভেন্দুদা আমার সহকর্মী। আমরা দু’জন একটাই দল করি। দু’জনেরই প্রতীক জোড়াফুল। দু’জনেরই লক্ষ্য এক।’’ আর শুভেন্দুও প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘‘ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই। কখনও আমি, কখনও মুকুলদা, আমরা পরস্পর কথা বলে ঠিক করে নিয়েছি। সেইমতো কেউ বহরমপুরে, কেউ কলকাতায় যোগ দিচ্ছেন।’’

যদিও ফাটলের রেখাটা ধরিয়ে দিয়ে বহরমপুরে ‘সাবেক’ তৃণমূলের একমাত্র কাউন্সিলর কানাই রায় বলেই ফেলেছেন, ‘‘এত দিন দলটা করলাম। তিন বারের কাউন্সিলর আমি। অথচ ওঁরা দল বেঁধে কলকাতায় গিয়ে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন, কেউ জানালই না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC Berhampur Municipality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE