Advertisement
E-Paper

বুদ্ধদেবের কনভয় লক্ষ্য করে ল্যান্ডমাইন, চার্জশিট দিতে গড়াল ৮ বছর

এমন ঘটনা, যেখানে বিস্ফোরণে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছিল। যার অভিঘাতে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় মাওবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় পশ্চিমবঙ্গে। উত্তাল হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি।

শিবাজী দে সরকার ও সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩৫
বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি। —ফাইল চিত্র।

বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি। —ফাইল চিত্র।

এমন ঘটনা, যেখানে বিস্ফোরণে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছিল। যার অভিঘাতে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় মাওবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় পশ্চিমবঙ্গে। উত্তাল হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি।

ঘটনা, মানে শালবনি থানার কেস নম্বর ৮১/০৮, তারিখ ০২.১১.২০০৮। সে দিন শালবনিতে জিন্দলদের ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস করে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মেদিনীপুর শহরে ফিরছিলেন, তাঁর কনভয় লক্ষ করে ল্যান্ডমাইন ফাটায় মাওবাদীরা। বুদ্ধবাবু অল্পের জন্য রক্ষা পান। এত বড় কাণ্ড, অথচ তার চার্জশিট পেশ করতে আট-আটটা বছর লেগে গেল! উপরন্তু ধেয়ে এল বেশ কিছু প্রশ্ন ও পক্ষপাতের অভিযোগ।

গত সেপ্টেম্বরে কিছুটা চুপিসারেই মেদিনীপুর আদালতে সিআইডি শালবনি-চার্জশিট জমা দিয়েছে। বিস্ফোরণের পরবর্তী আড়াই বছর বুদ্ধবাবুরই বাম সরকার ক্ষমতায় ছিল। তখন যেমন তদন্ত এগোয়নি, তেমন তৃণমূল জমানার প্রথম পাঁচ বছরেও মামলার হাল-হকিকত শুধোলে পুলিশকর্তারা শুধু বলে গিয়েছেন, ‘তদন্ত শেষ হয়নি।’ চার্জশিটে বিলম্বের কারণ হিসেবে এখন এক সিআইডি-কর্তার ব্যাখ্যা— ‘‘ফরেন্সিকের মতো কিছু রিপোর্টের অপেক্ষায় ছিলাম। সে সব দেখে চার্জশিট হয়েছে।’’

কিন্তু যে বিস্ফোরণের পরের ভোরেই স্বয়ং ডিজি’কে ছুটে যেতে হয়েছিল, তার রিপোর্ট পেতে এত বছর লেগে যাওয়া কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সে প্রশ্ন উঠছে। যার জবাবে গোয়েন্দা-সূত্রের বক্তব্য: এ জাতীয় মামলায় সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে সবুজ সঙ্কেত মিললে তবেই চার্জশিট দাখিল হয়। এখানে তা-ই হয়েছে।

টার্গেট বুদ্ধ

শালবনি বিস্ফোরণ

• ঘটনা নভেম্বর, ২০০৮

• চার্জশিট সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কী হয়েছিল

• তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয় আগে বেরিয়ে যায়।
ল্যান্ডমাইন ফাটায় মাওবাদীরা।
দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পাইলট কার ক্ষতিগ্রস্ত। জখম ৬ জন পুলিশকর্মী

চার্জশিটে ৯

জেলে বন্দি

• সুদীপ চোংদার ওরফে কাঞ্চন

• মনসারাম হেমব্রম ওরফে বিকাশ

• কল্পনা মাইতি ওরফে অনু

এখনও ফেরার

• সন্তোষ পাত্র

জামিনে মুক্ত

• করণ হেমব্রম

• ভাগবত হাঁসদা

• সুনীল হাঁসদা

• সহদেব মাহাতো

• লক্ষ্মীরাম মুর্মু

অভিযোগ

• দেশদ্রোহ, খুনের চেষ্টা, বিস্ফোরণ, ষড়যন্ত্র

দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি নানা সংশয়ের অবকাশও থাকছে। যেমন, আদালত-সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাষ্ট্রদ্রোহ, খুনের চেষ্টা, ষড়যন্ত্র-সহ ভারতীয় দণ্ডবিধির ১১টি ধারা ও বিস্ফোরক-আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে চার্জশিটে। কিন্তু বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) প্রযুক্ত হয়নি। শুনে নানা আইনি বিশেষজ্ঞের ভুরুতে ভাঁজ। ‘‘মাওবাদী কার্যকলাপের বহু লঘু মামলাতেও ইউএপিএ জোড়া হয়। এমন একটা সাংঘাতিক ঘটনায় হল না কেন, মাথায় ঢুকছে না।’’— মন্তব্য এক আইনজীবীর।

শালবনি-চার্জশিটে নাম আছে মোট ন’জনের। পুলিশের দাবি, প্রত্যেকেই মাওবাদী রাজনীতি ও কার্যকলাপে জড়িত ছিল। এদের তিন জন— কল্পনা মাইতি, বিকাশ ও মাওবাদী পার্টির প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক কাঞ্চন আপাতত জেলে। জামিন নিয়ে বাইরে পাঁচ জন— সুনীল হাঁসদা, সহদেব মাহাতো, লক্ষ্মীরাম মুর্মু, ভাগবত হাঁসদা ও করণ হেমব্রম। ফেরার দেখানো হয়েছে এক জনকে— লালগড়ের দ্বারিগেড়িয়া গ্রামের সন্তোষ পাত্র।

সিআইডি’র খবর: শালবনি-কাণ্ডের প্রাথমিক তদন্তে প্রথমেই উঠে এসেছিল লালগড়ের মাওবাদী ‘প্লাটুন কমান্ডার’ করণের নাম। ২০০৮-এর ৫ নভেম্বর গভীর রাতে মূলত করনেরই খোঁজে তার গ্রাম ছোটপেলিয়ায় হানা দেয় পুলিশ। অভিযোগ ওঠে, সেখানে পুলিশ মহিলাদের শারীরিক নিগ্রহ করেছে, এমনকী ছিতামুনি মুর্মু নামে এক মহিলার চোখ রাইফেলের বাটে থেঁতলে দিয়েছে।

এরই জেরে ৬ নভেম্বর সকালে আন্দোলনে নামে লালগড়। বাকিটা ইতিহাস। পরে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, শালবনির বেলাশোল গ্রামের শুকদেব ওরফে বাদল মাহাতো বরুয়া গ্রামের কাছে ধানখেতে বুকে হেঁটে গিয়ে মাইন পুঁতেছিল। মাইন ফাটাতে ফ্ল্যাশগানের সুইচ-ও টিপেছিল সে। ২০১২-র জানুয়ারিতে বাদল ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেই ইস্তক তার ঠিকানা মেদিনীপুর পুলিশ লাইন। স্পেশ্যাল হোমগার্ড হিসেবে মাসোহারাও বরাদ্দ।

এ হেন লোকটির নাম চার্জশিটে না-থাকাটাও নানা মহলে বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। শুক্রবার ছোটপেলিয়া থেকে ফোনে করণ বলেন, ‘‘আমি তখন দলের কোনও কিছুতে থাকতাম না। ব্যক্তিগত কারণে বিকাশ আমাকে সাসপেন্ড করেছিল। অথচ চার্জশিটে আমার নাম রইল। বাদল বাদ গেল!’’ করণের পর্যবেক্ষণ, ‘‘বাদল এখন পুলিশের লোক। ওকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী করা হবে। তাই ছাড়।’’ এক সিআইডি-অফিসারের কথায়, ‘‘ধরা দিলে অনেক সময়ে মামলায় রেহাই দেওয়া হয়। তা-ই হয়েছে।’’

গোয়েন্দা সূত্রের খবর: বিস্ফোরণ-চক্রান্তে সরাসরি জড়িত আরও তিন জনের নাম বাদল জেরায় ফাঁস করে। তাদের মধ্যে শশধর মাহাতো ২০১১-য় নিহত হয়েছে, সচিন মুন্ডা ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা। আর তৃতীয় জন, অর্থাৎ বীরেন আদিবাসী ওরফে মঙ্গলের নাম এই মুহূর্তে বিবেচনা করা হচ্ছে মাওবাদী পুনর্বাসন প্যাকেজের জন্য। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, শালবনির ছেলে বীরেনের দাদা শাসক দলের স্থানীয় নেতা।

এই সূত্রেই ‘রাজনীতির রং’ লাগছে চার্জশিটের গায়ে। ‘‘আমরা যাঁরা জামিন পেয়ে বাইরে এসেও তৃণমূলে নাম লেখাইনি বা পুলিশের চর হইনি, চার্জশিটে তারাই থাকল। আসল দোষীরা বাদ পড়ল তো বটেই, তাদের দুধে-ভাতে রাখারও বন্দোবস্ত হচ্ছে!’’— আক্ষেপ এক অভিযুক্তের। চার্জশিটে সন্তোষ পাত্রের নাম দেখে গোয়েন্দাদের অনেকেও বিস্ময় লুকোননি। তাঁদের বক্তব্য, লালগড় আন্দোলন পর্বে বহু হিংসায় সন্তোষের নাম জড়ালেও বিস্ফোরণের সময়ে সে মাওবাদীদের সঙ্গে ছিলই না।

buddhadeb bhattacharjee Convoy car
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy