Advertisement
E-Paper

শাসকের চাপে নতিস্বীকার সুশান্তের

পর্বতের মূষিক প্রসব আর কাকে বলে! বিরোধীদের চাপের মুখে বিধাননগর, আসানসোল ও বালি পুর-এলাকার ভোট গণনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫৩

পর্বতের মূষিক প্রসব আর কাকে বলে!

বিরোধীদের চাপের মুখে বিধাননগর, আসানসোল ও বালি পুর-এলাকার ভোট গণনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সেই সিদ্ধান্ত জেনেই খড়গহস্ত শাসক দলের শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীরা সোমবার দিনভর ধর্না দিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের দফতরে। ধর্নারত মন্ত্রীদের কাছে বারদশেক ফোন এল ভূটান সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের! তার পরে রাতেই সুশান্তবাবু জানিয়ে দিলেন, আড়াইখানা পুর-নিগমের ভোটগণনা হবে ৯ অক্টোবর। আগে যা হওয়ার কথা ছিল ৭ তারিখ। মাত্র দু’দিন ভোট গণনা পিছিয়ে কী লাভ হল, প্রশ্ন তুলে বিরোধীরা গোটা ঘটনাপ্রবাহকে শাসক দল ও কমিশনের ‘গড়াপেটা খেলা’ বলেই অভিযোগ করছে!

তৃণমূলের অবশ্য দাবি ছিল, ৭ তারিখ অর্থাৎ বুধবারই শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের সঙ্গে আড়াইখানা পুর-নিগমেরও ভোট গণনা করতে হবে। সরাসরি সেই দাবি নির্বাচন কমিশনার মানেননি ঠিকই। কিন্তু তাঁর নতুন সিদ্ধান্ত নতুন কিছু স্ব-বিরোধিতার জন্ম দিয়েছে। সুশান্তবাবুই এ দিন সন্ধ্যায় বলেছিলেন, বিধাননগর, বালি ও আসানসোলের গণনা ৭ তারিখ হচ্ছে না। কমিশনের যদি ৪৫০টি ক্যামেরা থাকে, তা হলে তার মধ্যে ১০০টা ক্যামেরার ছবি থেকে অভিযোগ পেয়েছেন। সেই সব ছবি খতিয়ে দেখতে হবে। অথচ মাত্র দু’ঘণ্টা পরে সব ছবি দেখে ফেলে সুশান্তবাবু জানিয়েছেন, গণনা হবে ৯ তারিখ! আর তিনটি পুর-এলাকারই কিছু বুথে ৮ তারিখ পুনর্নির্বাচন হবে। কমিশনের বাইরে তখন ঠায় বসে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা! স্বভাবতই বিরোধীদের প্রশ্ন, ১০০টা ক্যামেরার ছবি এবং অন্যান্য তথ্য খতিয়ে দেখে সত্যিই যদি অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়, তা হলে তার নিরিখে ফের ভোটের রাস্তা খোলা থাকছে কোথায়? শাসকের চাপের মুখে যেনতেনপ্রকারেন গণনার দিন ঘোষণা করেই কি নিস্তার পেতে চাইলেন নির্বাচন কমিশনার?

কমিশনের নতুন সিদ্ধান্ত জেনে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী যেমন বলেছেন, ‘‘১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন নির্বাচন কমিশনার! দু’ঘণ্টায় তাঁর ১০০ ক্যামেরার ছবি খতিয়ে দেখা হয়ে গেল?’’ সুজনবাবুর বক্তব্য, গণনা স্থগিত রাখার দাবি তাঁরা জানাননি। তাঁদের দাবি, তিনটি পুর-এলাকাতেই প্রহসনের ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন। সেই দাবিই তাঁরা বহাল রাখছেন। গণনা স্থগিত রাখার কথা যিনি রবিবার প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন, বিজেপি-র সেই রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের প্রতিক্রিয়া, ‘‘তৃণমূল গুন্ডা়মি করে নির্বাচন কমিশনারকে দিয়ে এটা বলিয়ে নিল! আমরা আজ, মঙ্গলবার বৈঠক করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করব।’’ বিজেপি-রই বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘সেই যদি মাথা নোয়ালে, তবে কেন লোক হাসালে!’’ প্রদেশ কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল মান্নানের মন্তব্য, ‘‘আমি রবিবারই বলেছিলাম, এটা গট আপ! সেটাই স্পষ্ট হয়ে গেল!’’ তিন বিরোধী দল সূত্রেই ইঙ্গিত মিলছে, তিনটি পুর-এলাকার ‘লুঠ হয়ে যাওয়া নির্বাচন’ বাতিল করার দাবিতে শেষ পর্যন্ত আইনি পথে যাওয়ারও প্রস্তুতি চলছে।

শাসক দল অবশ্য এ সবের পরেও বেপরোয়া! একে তো কমিশনে গিয়ে এ ভাবে মঞ্চ বেঁধে রাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের ধর্না দেওয়াই নজিরবিহীন! তার পরেও রাতে সুশান্তবাবুর নয়া ঘোষণা শুনে পার্থবাবুর হুঁশিয়ারি, ‘‘নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ৯ তারিখ তিনটি পুরসভার গণনার কাজ হাতে নেওয়া হবে। মাঝে দু-একটা দিন সময় নেওয়া হচ্ছে কিছু পুনর্নির্বাচনের জন্য। আমরা নজর রাখব!’’ রাতে পার্থবাবু, সুব্রতবাবুরা কমিশনের দফতর ছাড়লেও বাইরের মঞ্চ কিন্তু গোটানো হয়নি। সেখানে রাতভর লোক থাকছে। ধর্না-মঞ্চ ৯ তারিখ পর্যন্তই থাকবে বলে খবর। অর্থাৎ এখন শাসকের নজরবন্দি সুশান্তবাবু!

বস্তুত, সকাল থেকে কমিশনে বসে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা যা করেছেন, তাকে নিছক নজরদারি বললেও কম বলা হয়! কমিশন সূত্রের খবর, শুধু নিজেদের দাবি জানিয়েই ক্ষান্ত হননি তাঁরা। কীসের ভিত্তিতে কমিশনার গণনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন, দফায় দফায় তা জানতে চেয়েছেন। কমিশনার ব্যাখ্যা দিলে তাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জও করেছেন! প্রিসাইডিং অফিসারদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই সাধারণত কমিশন পুনর্নির্বাচন বা অন্য সিন্ধান্ত নেয়। সরকারে থাকার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে প্রিসাইডিং অফিসারদের রিপোর্টের প্রতিলিপি তাঁরাই দেখিয়ে দিয়েছেন কমিশনকে! সঙ্গে হুঁশিয়ারি, দাবি না মানলে এ সব রিপোর্ট তাঁরাই সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দেবেন! এরই মধ্যে নেতা-মন্ত্রীরা বারবার উঠে গিয়ে ফোনে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে।

গোটা ঘটনাপ্রবাহ যে বেআইনি, অসাংবিধানিক এবং চাপসৃষ্টির প্রচেষ্টা, তা একান্তে মেনে নিচ্ছেন শাসক দলের কোনও কোনও নেতাও। তেমনই এক জনের কথায়, ‘‘নির্বাচনকে প্রহসনে নামিয়ে আনার জন্য ১৯৭২ সাল কুখ্যাত। তার জন্য কংগ্রেসকে আজও মাসুল গুনতে হয়। কিন্তু কয়েকটা সামান্য পুরভোট ঘিরে যা হল, সেটা তো ’৭২-এর বাবা!’’

ঘটনার জল যে এই দিকেই গড়াতে পারে, এ দিন সকাল থেকেই তার ইঙ্গিত ছিল। কমিশনের সামনে মঞ্চ বেঁধে তৃণমূলের কাউন্সিলর ও অন্য নেতারা সারা দিন ধরে বক্তৃতা চালিয়ে গিয়েছেন। পার্থবাবুর নেতৃত্বে চার জনের একটি প্রতিনিধিদল দাবিপত্র জমা দেওয়ার জন্য ভিতরে ঢুকেছিল। তার পরেই কমিশনের ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভিতরে থাকাকালীন অন্তত ৫-৬ বার সুশান্তবাবুর ঘরে ঢুকেছিলেন সুব্রতবাবুরা।

আর বাইরে মাইক বেঁধে অবিরাম চলেছে কমিশন, বিরোধী এমনকী রাজ্যপালকে কাঠগড়ায় তুলে বক্তৃতা! ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, পুরভোটে সিপিএমের ‘সন্ত্রাসে’র বিরুদ্ধে আজ, মঙ্গলবার কলেজ স্ট্রিট থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মিছিল হবে। ভোট গণনার দিন না জানালে মিছিলের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হবে কমিশনের দিকেই!

এত সব কাণ্ড কি তাঁর উপরে চাপ সৃষ্টির জন্যই? সন্ধ্যায় সুশান্তবাবুর জবাব ছিল, ‘‘কমিশনের সিদ্ধান্ত বদল করতে কারও চাপ দেওয়া উচিত নয়।’’ আরও বলেছিলেন, ‘‘যেটুকু অতীত ইতিহাস দেখেছি, তাতে নির্বাচন কমিশনের সামনে মঞ্চ বেঁধে ধর্নায় বসার কোনও নজির নেই!’’ জানিয়েছিলেন, ভোট গণনার জন্য মিউনিসিপ্যাল রির্টানিং অফিসারদের কমপক্ষে তিন দিন সময় দিতে হয়। তার মানে ভোট গণনার নতুন তারিখ ৯ অক্টোবরের আগে হতে পারে না?

কমিশনার তখন বলেছিলেন, ‘‘সিদ্ধান্ত আপনাদের। আমি বলতে পারি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিদ্ধান্ত নেব। তবে তার আগে সব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে।’’ দু’ঘণ্টা পরে অবশ্য সেই ৯ তারিখের কথাই তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন!

লালবাজার অভিযানের উপরে পুলিশের লাঠিচালনা, তিনটি পুর-এলাকার নির্বাচনে ভোট লুঠ ও সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিবাদে এ দিনই ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মিছিল ছিল বামেদের। মিছিল শেষে পার্থবাবুর উদ্দেশে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর কটাক্ষ, ‘‘যে তিন-চার ঘণ্টা উনি কমিশনে বসে থাকলেন, সেই সময়ে সংবিধানটা পড়ে ফেলা যায়! পড়ে নিলে বুঝতে পারতেন, যা করছেন, এ সব করা যায় না! এর পরেও গণতন্ত্রের কথা বলে তৃণমূল মিছিল করবে?’’

তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এ সব কটাক্ষ গায়েই মাখছেন না। তবে দলের অন্দরে এক নেতা বলছেন, ‘‘শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ফলাফল কিন্তু ৭ তারিখেই ঘোষণা হবে। সে দিন যদি বামফ্রন্ট জিতে যায় এবং ৯ তারিখ পুর-নিগমগুলিতে আমরা জিতি, মানুষের কাছে বার্তা যাবে— একটু সুষ্ঠু ভাবে ভোট হতে দিলেই আমাদের বিপদ!’’

sushanta ranjan upadhyay state election commissioner under pressure 9th october vote counting abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy